রেলক্রসিংগুলো যেন অবহেলার অপর নাম। সারা দেশে ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। অর্থাৎ ট্রেন চলাচলের সময় যানবাহন আটকানোর জন্য কোনো পাহারাদার কিংবা প্রতিবন্ধক কিছুই নেই। বাকি ১৮ শতাংশ ক্রসিংয়ে পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক—দুটিই আছে। কিন্তু পাহারাদারের অবহেলায় কিংবা চালকের অসতর্কতায় সেগুলোতেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রেলপথে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, এর ৮৫ শতাংশই মারা যান রেলক্রসিংয়ে। অবশ্য রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যুর হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ রাখে না। মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, এক ট্রেনকে অন্য ট্রেনের ধাক্কা, রেলক্রসিংয়ে গাড়িকে ট্রেনের চাপা—এসবকে দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সারা বিশ্বেই রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু রেলক্রসিংয়ের কারণে রেলপথ পুরোপুরি নিরাপদ হতে পারছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান বলেন, অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ট্রেন এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘণ্টা বাজার ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরা।
তবে পাহারাদার যেখানে আছে, সেখানে দুর্ঘটনা এড়াতে সবার সচেতনতা দরকার। তিনি বলেন, পাহারাদারের ভুলে দুর্ঘটনা হলে অবশ্যই শাস্তি হবে। তবে অনেক চালক বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়ে পার হতে গিয়েও দুর্ঘটনায় পড়ছেন।
সম্প্রতি উন্নয়ন হয়েছে মিরসরাইয়ের রেলক্রসিংয়ের
গতকাল শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলস্টেশন এলাকায় পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে নিয়ে যায় চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন। এতে মাইক্রোবাসে থাকা ১১ জন নিহত হন। এ ঘটনার পর পাহারাদারকে আটক করে পুলিশ।
রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছের এই রেলক্রসিং একটি প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি উন্নয়ন করা হয়েছে। পাহারাদারের বেতন দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প থেকেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকার পরও দুর্ঘটনার বিষয়টি উদ্বেগজনক।
রেলওয়ের নথিপত্র অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে রেলক্রসিংকে নিরাপদ করতে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করেছে রেলওয়ে। দুটি প্রকল্পের আওতায় রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭০২টি রেলক্রসিং উন্নয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৩২ জন। রেলক্রসিং উন্নয়নের মধ্যে প্রতিবন্ধক বসানো ও পাহারাদারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরপরও রেলক্রসিং নিরাপদ হয়নি।
রেলের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, দুর্ঘটনার পর পাহারাদার সাদ্দাম হোসেন পালিয়ে যাননি। তিনি রেল কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি প্রতিবন্ধক নামিয়ে যানবাহন আটকে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাইক্রোবাসটি যাওয়ার জন্য কেউ একজন প্রতিবন্ধক তুলে দিয়েছিল। এই দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগে চট্টগ্রাম থেকে মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকার দিকে আসে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পরই আসল সত্যটা জানা যাবে।
সড়কে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির সুনির্দিষ্ট আইন আছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির বিধান নেই। উল্টো যানবাহনের চালককে দায়ী করে রেল কর্তৃপক্ষ। বড়জোর পাহারাদারের ভুল পেলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু রেলে পাহারাদারের সংকট থাকায় কদিন পরেই আবার দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয় বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে গতানুগতিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করে। একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় সব প্রতিবেদনেরই ভাষা, সুপারিশ ও দায়ী করার পদ্ধতি একই।
রেলওয়ে সূত্র আরও জানায়, পাহারাদারের চাকরি স্থায়ী নয়। প্রকল্পের অধীনে সর্বসাকল্যে ১৪ হাজার টাকার মতো তাঁদের বেতন। ২০১৫ সালের পর দুটি প্রকল্পের অধীনে তাঁদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলে বেতন থাকবে না। এ জন্য শুরুতে নিয়োগ পাওয়া অন্তত ৩০০ পাহারাদার চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। অস্থায়ী চাকরি বলে তাঁদের প্রশিক্ষণেরও খুব একটা ব্যবস্থা নেই।
রেলের হিসাবে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ২২১ জন। এর মধ্যে ১৮৭ জনই প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে। অর্থাৎ রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি ৮৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।
৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেলক্রসিং নিরাপদ করার দুটি উপায় আছে। ১. রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কে উড়ালপথ নির্মাণ করা। ২. ট্রেন আসার সময় যানবাহন আটকে দেওয়ার জন্য পথরোধক (ব্যারিকেড) বসানো এবং ট্রেন এলে তা সময়মতো নামিয়ে যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখার জন্য পাহারাদার নিয়োগ।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, নতুন রেললাইন তৈরি করে প্রথম ট্রেন চালানোর ১০ বছরের মধ্যে এর ওপর দিয়ে কোনো সড়ক গেলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের। এরপর কোনো সড়ক নির্মাণ হলে তা আগে রেল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সড়কের কারণে তৈরি রেলক্রসিংয়ে পথরোধক ও পাহারাদার দিয়ে তা সুরক্ষা করার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার। এটা না করলে রেল এসব ক্রসিংয়ের অনুমোদন নেই বলে বিবেচনা করে। এগুলোতে পাহারাদার কিংবা প্রতিবন্ধক থাকে না, যা পুরোপুরি অরক্ষিত।
রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬১। এগুলোর মধ্যে অনুমোদন নেই ১ হাজার ৩২১টির। এসব ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। আরও আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে। সব মিলিয়ে দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত।
রেলওয়ে গত এক যুগে রেললাইন তৈরি ও কেনাকাটায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সওজ প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না।
রেললাইনের ওপর উড়ালপথ নির্মাণে এক যুগের বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে। সওজ অল্প কিছু মহাসড়কের উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে। অন্যগুলোতে উড়ালসড়ক নির্মাণ কে করবে, সেটাই ঠিক করতে পারছে না সংস্থাগুলো। ফলে অরক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলে বিপুল বিনিয়োগের ফলে ট্রেনের গতি বাড়বে—এটাই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু রেলক্রসিং অরক্ষিত রেখে গতি বাড়ানো যাবে না। তিনি আরও বলেন, সব রেলক্রসিং পর্যায়ক্রমে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনতে হবে।
এর আগে তাৎক্ষণিকভাবে সব ক্রসিংয়ের দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি গতিরোধক বসাতে হবে। প্রতিটি ক্রসিংয়ে ফ্লাশিং লাইট বসাতে হবে, যাতে ট্রেন এলে জ্বলে ওঠে। ক্রসিংয়ে ঘণ্টা বসাতে হবে, যা ১০০ ডেসিবেল শব্দ সৃষ্টি করে।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post