অ্যানালাইসিস বিডি
দুর্নীতি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল-বাণিজ্য এগুলো পুরনো গল্প। বিগত ১২ বছর ধরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা এসব করে আসছে। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় বড় আকারে তাদের দুর্নীতির নিউজের হেড লাইন হচ্ছে। এগুলো পড়তে পড়তে এখন জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জনগণ এখন এসবকে স্বাভাবিক মনে করে। আর স্বাভাবিক মনে না করেও কোনো উপায় নেই।
কিন্তু তাই বলে কি ক্ষমতাসীন দলের একটি অংগসংগঠনের সব নেতাকর্মীই চাদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজিতে জড়িয়ে পড়ে? এতদিন জেনে আসছি- একটি সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী অপরাধ অপকর্মের সাথে জড়িত থাকে, আর বেশির ভাগ নেতাকর্মী ভাল থাকে। কিন্তু জাতীয় শ্রমিক লীগ মানুষের সেই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। এই সংগঠনটির প্রায় সব নেতাকর্মীই অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে।
একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, শ্রমিক লীগের ৭ লাখ সদস্যের মধ্যে ৫ লাখই চাঁদাবাজিতে জড়িত। জাতীয় শ্রমিক লীগের নামে ৪২৬ খাতে বছরে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা উঠাতে এলাকা, প্রতিষ্ঠান ও খাতভিত্তিক সংশ্লিষ্ট নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া আছে।
চাঁদা আদায়ের উল্লেখযোগ্য খাত হল গণপরিবহন। এ খাত থেকে প্রতিদিন তোলা হয় ৪ কোটি টাকার চাঁদা। এছাড়া উল্লেখযোগ্য খাত হলো, ব্যাংকিং, সিটি করপোরেশন, রাজউক, ওয়াসা, ট্যানারি, ডিপিডিসি, ডেসকো, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা ঘাট প্রভৃতি। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানেই আছে শ্রমিক লীগের শাখা। দেশব্যাপী ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ লাখই চাঁদাবাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূল শ্রমিক লীগের অনেক নেতাও চাঁদাবাজির টাকায় হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকার অভিজাত এলাকায় রয়েছে অনেকের আলিশান বাড়ি। চলাচল করেন দামি গাড়িতে। জাতীয় শ্রমিক লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চাঁদাবাজির ভাগাভাগি ও কমিটি গঠন বাণিজ্য নিয়ে দ্ব›দ্ব এখন চরমে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণপরিবহনে শ্রমিক লীগের চাঁদাবাজি অপ্রতিরোধ্য। শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল/ক্রাফট ফেডারেশনের অন্যতম হলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ। এ সংগঠনের একশ্রেণির নেতার একমাত্র কাজ চাঁদাবাজি করা। পরিবহন সেক্টরে মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষ থেকে পৃথকভাবে চাঁদা তোলা হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষেও শ্রমিক লীগ নেতারা চাঁদা আদায় করেন।
জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের বাসচালকদের প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা গুনতে হয়। বিশেষ করে ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, গাবতলী, আব্দুল্লাহপুরসহ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা আদায় করে। একেক রুট থেকে ছয় থেকে সাত ধাপে চাঁদার টাকা তোলা হয়। শ্রমিক লীগের রাজধানীর থানা পর্যায়ের নেতাদেরও চাঁদা তোলার খাত রয়েছে অনেক। রাজধানীর সবচেয়ে বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কাওরান বাজার এখন চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্য। নানা উপায়ে দিনভর চলে হরদম চাঁদাবাজি। এদিকে সিবিএ নেতাদের নামে রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকিং সেক্টরে শ্রমিক লীগ নেতাদের অপকর্মের যেন শেষ নেই। সবগুলো ব্যাংকই এখন শ্রমিক লীগ সমর্থিত সিবিএ কমিটি দিয়ে চলছে। ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি ও অনিয়মে তারা জড়িত।
পরিবহন সেক্টর ছাড়াও শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত বাকি ১৫টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল/ক্রাফট ফেডারেশনগুলো হলো : জাতীয় রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগ, জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ ট্রাক চালক শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সংস্থা শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস, ও খনিজ সংস্থা শ্রমিক কর্মচারী লীগ ফেডারেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বশিউক রাবার বিভাগ, সিলেট জোন শ্রমিক/কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ কুলি শ্রমিক লীগ, মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগ, বাংলাদেশ নৌকা মাঝি শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ বিড়ি শ্রমিক লীগ। এসব সংগঠনের এক শ্রেণির নেতারা নিয়মিত চাঁদাবাজির টাকা তুলে কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের এক শ্রেণির নেতার কাছে দেন। জানা গেছে, জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন আছে ৭৮টি। এসব সংগঠনগুলোর এক শ্রেণির নেতারা চাঁদাবাজি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নান অপকর্মে নিয়োজিত।
ন্যাশনাল ইউনিয়নগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো :বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কর্মচারী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্রমিক কর্মচারী লীগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্মচারী ইউনিয়ন, ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, বি আরটিসি শ্রমিক কর্মচারী জোট, বিমান শ্রমিক লীগ, তিতাস গ্যাস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, রূপালী ব্যাংক কর্মচারী সংসদ, জীবন বীমা কর্মচারী ইউনিয়ন প্রমুখ। অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন আছে।
শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত বেসিক ইউনিয়ন আছে ৩৩৩টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ওয়াসা, রাজউক, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসি, এফডিসি, ডেসকো, গণপূর্ত যান্ত্রিক কারখানা, ট্যানারি, জাতীয় জাদুঘর, কম্পিউটার কাউন্সিল, এনটিআরসিএ, ঢাকা ঘাট, হোটেল সোনারগাঁও, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কাওরান বাজার রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ প্রমুখ। এসব সংগঠনের এক শ্রেণির নেতারা বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িত।
Discussion about this post