অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আজাদসহ ৯ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু তাই নয় কথিত সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা দিয়ে তাদেরকে ৪ দিনের রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ।
এরপর গতরাতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর জনাব আ ন ম শামসুল ইসলামকে উত্তরার বাসা থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে গিয়েছে। এছাড়া গ্রেফতারে প্রতিবাদে বিক্ষোভ করতে গেলে নোয়াখালী জেলা শাখার আমীর মাওলানা মোঃ আলাউদ্দিন এবং জেলা কর্মপরিষদ ও মজলিসে শূরা সদস্য জনাব নাসিমুল গনি চৌধুরীসহ ৩ জন নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ।
হঠাৎ করেই জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার কেন তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। যদিও বিরোধীদলের নেতাকর্মীদেরকে আটকের পর রিমন্ডে নেয়া শেখ হাসিনার সরকারের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ বিশেষ। অমানবিক এই রিমান্ডকে শেখ হাসিনা বিগত ১২ বছর ধরে বিরোধীদল নির্মূলের উত্তম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। অনেকেই বলছেন আওয়ামীলীগ বিরোধীমত দমনে সবসময় গুম, খুন, হত্যা, গ্রেফতার করে আসছে। তবে সবক্ষেত্রে তীরটা যেন জামায়াতের দিকেই সব সময় বেশি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার পুলিশলীগ হঠাৎ করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে গ্রেফতার করলো কেন? তাদের অপরাধ কি? জামায়াতকে নিশ্চিহৃ করার জন্য শেখ হাসিনা দলটির শীর্ষনেতাদেরকে কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াতের দলীয় প্রতীকটি কেড়ে নিয়েছে। এছাড়া বিগত ১২ বছর ধরে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের উপর সীমাহীন জুলুম নির্যাতনতো চলছেই।
সাংবিধানিকভাবে জামায়াতে ইসলামী একটি বৈধ রাজনৈতিক দল। সরকার কিংবা আদালত কর্তৃক জামায়াত নিষিদ্ধ নয়। নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অধিকার জামায়াতের আছে। আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতেরও সভা-সমাবেশ ও ঘরোয়া বৈঠক করার অধিকার আছে। অথচ দখলদার হাসিনা সরকার আজ জামায়াতের সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশতো দূরের কথা ঘরোয়া বৈঠকও করতে দিচ্ছে না।
জানা গেছে-করোনাকালীন সময়ে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাড়ানো যায়, কিভাবে অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণ সামগ্রী পৌছে দেয়া যায়-তা নিয়ে একটি ঘরোয়া বৈঠক করছিলেন জামায়াতের শীর্ষনেতারা। এই বৈঠক থেকে শেখ হাসিনার পুলিশলীগের সদস্যরা জামায়াত নেতাদেরকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। লক্ষণীয় বিষয় হল-নিরপরাধ জামায়াত নেতাদেরকে গ্রেফতার করে তাদের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছে আওয়ামী পুলিশ লীগ। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদেরকে আবার রিমান্ডেও নিয়েছে।
দেখা গেছে, বিগত ১২ বছরে জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা শেখ হাসিনা করেনি। জামায়াত-শিবিরের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে শেখ হাসিনার দলীয় ক্যাডার, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি হত্যা করেছে। গুম করেছে অনেক নেতাকর্মীকে। তারপরও জামায়াতকে নিয়ে শেখ হাসিনার এত আতঙ্ক কেন? কেন করোনাকালীন সময়েও জামায়াতের নিরপরাধ শীর্ষনেতাদেরকে গ্রেফতার করেছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা জামায়াতকে দমনে ব্যর্থ। ভারতের নির্দেশেই আবারও জামায়াতের ওপর চড়াও হয়েছেন হাসিনা। গত ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে উন্নত চিকিৎসার অযুহাতে ভারতে যান। এর আগে সরকারের কয়েকজন নেতা ও সেনাপ্রধানও ভারত সফর করেন। তারপর ভারতের উস্কানিতে আবারও জামায়াতের ওপর চড়াও হন হাসিনা সরকার। এছাড়া আওয়ামীলীগের ক্ষমতায় থাকতে সবচেয়ে বড় বাধা জামায়াত ইসলামী সেজন্য তাদেরকে গ্রেফতার করে সবসময় দমিয়ে রাখতে চায়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত একটি আদর্শিক সংগঠন। রাজনীতি শুধু মাত্র তাদের আদর্শের একটি অংশ। তাই কয়েক শ নেতাকর্মী মারা গেলেই যে একটি আদর্শিক দল শেষ হয়নি যায়নি সেটাও আওয়ামী লীগ ভাল করে জানেন। তাই জামায়াত-শিবিরকে কোনঠাসা করে রাখতেই স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জামায়াত-শিবিরের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে।
‘সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, সরকার অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদসহ ১০ জনকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে।
তিনি বলেন, এ ঘটনা রাজনৈতিক ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বোঝা উচিৎ জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে অতীতে কোনো সরকারের শেষ রক্ষা হয়নি; বর্তমান সরকারেরও হবে না। তিনি জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বেআইনীভাবে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।
গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মিরপুরে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ১০ জনকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের প্রতিবাদে এবং গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তর আয়োজিত এক বিক্ষোভ পরবর্তী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
এম আর করিম বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, গণমুখী ও আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সংবিধান মেনেই জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গণমানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। যেকোনো ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও রাজপথে সভা-সমাবেশ করা জনগণের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার হলেও সরকার জনগণের সে অধিকারকে অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে। এমনকি করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বৈঠক থেকে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে সরকার আবারো প্রমাণ করেছে তারা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক শাসনে বিশ্বাসী নয় বরং জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চায়। কিন্তু জনগণ তাদের সে স্বপ্নবিলাস কখনোই বাস্তবায়িত হতে দেবে না বরং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করবে। এছাড়া সারাদেশে জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়।
জামায়াত নেতাদের রিমান্ড শুনানিতে যা বললেন আইনজীবীরা
আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক, শিশির মনির, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি এমডি গোলাম রহমান ভুইয়া, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম কামাল উদ্দিন তাদের রিমান্ড আবেদন বাতিলসহ জামিনের আবেদন করেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম কামাল উদ্দিন আদালতে জামায়াতের গঠনতন্ত্র পড়ে শুনান।
শুনানিতে তিনি বলেন, মামলার জব্দ তালিকায় যা লেখা আছে তাতে রিমান্ড হয় না। ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোন কোনো নিষিদ্ধ ঘোষিত জিনিস নয়। শুধু জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা ও দায়িত্ব পালন করার ফলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করতে তাদের এই মামলায় আসামি করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নাই। তাই তাদের রিমান্ড বাতিলপূর্বক জামিনের প্রার্থনা করছি।
তিনি আরও বলেন, মিয়া গোলাম পরোয়ার ও হামিদুর রহমান আজাদ সাবেক সংসদ সদস্য। রফিকুল ইসলাম খানসহ কয়েকজনের বয়স ৮০ বছর। সার্বিক বিবেচনায় তাদের রিমান্ড বাতিল করে প্রয়োজনে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।
এস এম কামাল উদ্দিন বলেন, রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে নামঠিকানা যাচাই করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। অথচ মামলার আবেদন ও রিমান্ডের আবেদনে সকলের বিস্তারিত নাম ঠিকানা দেওয়া আছে। আসামিদের কাছে কোনো নিষিদ্ধ জিনিস পাওয়া যায় নাই। ল্যাপটপ, মোবাইল তো কোনো নিষিদ্ধ জিনিস নয়।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পরীমনি ইস্যু শেষ, এখন তো নতুন ইস্যু দরকার। জামায়াতে ইসলামী সকলের সঙ্গে মাঠে আন্দোলন করেছে। যখন যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তখন তারা ক্ষমতায় থেকে জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী নিষিদ্ধ বলার চেষ্টা করেছে।
এরপর আইনজীবী শিশির মনির তার শুনানিতে বলেন, মামলার এজাহারে এবং রিমান্ডের ফরোয়ার্ডিংয়ে বলা হয়েছে আসামিরা সরকার উৎখাতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন। জামায়াতে ইসলামী কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরিরসহন যে পাঁচটি সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নাম নেই। তাদের কোনো কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ নয়। তারা একসময় এই এ দেশের সরকারের অংশ ছিল। এখানে একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য আছেন। তাদের বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিদ। তাদের মতো লোক মিটিং বা সভা করতে পারেন তাতে কোনো বাধা নাই।
তিনি আরও বলেন, রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে আসামিদের সঠিক নাম ঠিকানা যাচাই করা প্রয়োজন। আবার প্রত্যেক আসামির বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে একই কাগজে। এসময় তিনি ওই রিমান্ড আবেদনের কপি আদালতে উপস্থাপন করেন। শুধু জামায়াতে ইসলামী করায় আসামিদের সবাইকে ১০ রিমান্ডে নিতে আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা যারা এখানে আছি তারা সবাই জামায়াতে ইসলাম করি। তারা সবাই এই সংগঠনকে টাকা দেই, কন্ট্রিবিউট করি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কন্ট্রিবিউট করে যাব। আমাদের সবাইকে রিমান্ডে নেওয়া হোক। তাদের যদি অন্যায়ভাবে রিমান্ডে নেওয়া হয় তাহলে আমরা সবাই রিমান্ডে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এ সময় উপস্থিত অনেক আইনজীবী তার বক্তব্য সমর্থন করেন।
শুনানি শেষে বিচারক তাদের চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। পরে হট্টগোলের জন্য আইনজীবীদের পক্ষে আব্দুর রাজ্জাক আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
Discussion about this post