অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার আবারো সারাদেশে ৭ দিনের কথিত ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশ-বিজিবির সাথে এবার মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সেনাবাহিনীও মাঠে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। ৭ দিনের লকডাউনে সরকারি বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি সেবা ছাড়া বন্ধ থাকবে সব যানবাহনও। এক কথায় বললে-অতি জরুরি দরকার ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বরে হতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন হল-দিনমজুর, শ্রমজীবী অর্থাৎ যারা দিন এনে দিন খায় তাদের কি অবস্থা হবে? সরকারের বিধি নিষেধের কারণে তারা বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারবে না। ৭ দিন ঘরের মধ্যেই অবস্থান করতে হবে। এ সময় তারা খাবে কি? তাদের বউ, ছেলে-মেয়েরা কি খেয়ে দিন কাটাবে?
গত বছর করোনার প্রথম দিকে লকডাউন ঘোষণা দিলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অসহায়-গরিব মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসছিল। আর সরকার যে ত্রাণ দিয়েছিল সেগুলো সরকারি দলের লোকেরাই খেয়ে ফেলেছে।
গত রমজান মাসে সরকার হঠাৎ করেই আবার সারাদেশে ১৪ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু দিন আনে দিন খায় এমন মানুষদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা সরকার করেনি। কিন্তু মানুষ না খেয়ে কত দিন ঘরে থাকতে পারে? লকডাউনের তিনদিনের মাথায়ই ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে শ্রমজীবী মানুষ। এরপর রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে দোকান মালিকরাও। সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের ঘোষণা ছাড়াই লকডাউন শিথিল হয়ে পড়ে।
পথেঘাটে ফুটপাতে চানাচুর, আচার, বাদাম ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করা দুলাল হোসেন জানান, গত বছর লকডাউনে তিনি ঘরের চাল থেকে ছয়টি টিন বিক্রি করে সংসার খরচ চালিয়েছেন। ঘরের খুঁটি লাগানো ও মেরামতের জন্য চার হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। সে টাকাও ব্যয় করে ফেলেছেন সংসারের কাজে। এবার লকডাউনে তিনি নিরুপায় হয়ে পরেছেন। বিক্রি করার মতো আর কিছুই নেই, হাতে জমা টাকাও নেই। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে কীভাবে লকডাউনের দিনগুলো কাটবে সে চিন্তায় তিনি বিভোর। পাচ্ছেন না কোনো সমাধান।
দুলালের স্ত্রী মহিমা বেগম (৪০) জানান, কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে। কখন যে তাদের এক চালা ঘরটি মাটিতে লুটিয়ে পরবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঘর মেরামত করতে পারছেন না, খুঁটি লাগাতে পারছেন না। এর মাঝে লকডাউন তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে।
তিনি বলেন, ‘হামারগুলার প্যাটোত ভাতই জোটে না। করোনা হামাকগুলাক ফকির করি দেইল। হামরা এ্যালা ক্যাং করি বাইচমো।’
পৌরসভার উত্তর সাপ্টানা এলাকার বিধবা কান্দ্রি বালা (৬২) জানান, গত বছরের লকডাউনে তার রিকশাচালক ছেলে ২০ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পরে। এখনও সেই টাকা শোধ করতে পারেনি। এবার লকডাউনে তাদের সংসার চালাটাই দুষ্কর হয়ে পরেছে।
তিনি বলেন, ‘হামার একটা গরু আছিল সেটাও বেচায়া দিছোং। গরু বেচা টাকা ভাঙি ভাঙি সংসারোত নাগাইছি। বাজারে জিনিসপাতির যে দাম তাতে হামার গরিব মাইনসের মরণ ছাড়া আর কিছু নাই।’
কান্দ্রি বালার ছেলে সুদান চন্দ্র (৪৪) জানান, রাস্তাঘাটে যাত্রী নেই। তাই রিক্সা নিয়ে বের হয়েও আয় করতে পারছেন না। প্রতিদিনের রোজগারে তাকে সংসার চালাতে হয়। রোজগার না থাকলে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। এ অবস্থায় পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে তাকে সুদে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিতে হচ্ছে।
শহরের শাহজাহান কলোনির দিনমজুর নবির হোসেন (৫৩) জানান, করোনায় লকডাউন গরিব মানুষের জন্য সর্বনাশ আর বিত্তশালী ও ব্যবসায়ীদের জন্য পৌষ মাস।
তিনি বলেন, ‘লকডাউনে জিনিসপাতির দামও বেড়ে যায়। গত বছরের লকডাউনের ক্ষতিই এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আবার এখন লকডাউনে আমাদের জীবন কষ্টদায়ক করে তুলেছে।
শহরের স্টেশন রোডের চায়ের দোকানদার জালার উদ্দিন (৪৪) বলেন, ‘আগের লকডাউনে শুধু চরা সুদে ঋণ নিয়ে চলতে হয়েছে। এতদিন রোজগার করে সেই সুদের টাকা পরিশোধ করছিলাম। আবার লকডাউনে সেই রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে।’
করোনা পরিস্থিতি গরিবকে আরও গরিব করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘লকডাউন গরিবের জন্য এক অভিশাপের নাম।’
দেখা গেছে, কোনো প্রকার পরিকল্পনা ছাড়া আবারো হঠাৎ করে ৭ দিনের কথিত কঠোর লকডাউন ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এবার জরুরি দরকার ছাড়া মানুষকে ঘরেই আটকে রাখা হবে। কিন্তু গরিব মানুষের খাবারের জন্য কোনো পরিকল্পনাই করেনি সরকার। তাদেরকে ত্রাণ দেয়ার কথাও বলেনি সরকার।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ মনে করছেন-সরকারের কথিত কঠোর লকডাউন আবারো ব্যর্থ হবে। কারণ, সরকার বললেই মানুষ ঘরে থাকবে না। করোনার চেয়ে পেটের ক্ষুধার যন্ত্রণা আরও বেশি। শ্রমজীবী মানুষ যখন দেখবে-বউ, ছেলে-মেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, তখন তারা আর ঘরে বসে থাকবে না। সব বেরিকেড ভেঙ্গে তারা রাস্তায় নেমে আসবে।
Discussion about this post