মার্চের শুরু থেকেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও সোমবারের আগ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সোমবার সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা এসেছে। যা দুই সপ্তাহের জন্যে কার্যকর।
কিন্তু, নির্দেশনাগুলো কি যথার্থ? শুধু নির্দেশনা দিয়েই কি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজের সঙ্গে।
অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মার্চের শুরু থেকে আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুনরায় বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু, সোমবারের আগ পর্যন্ত সরকার শুধু দৈনিক পরীক্ষা, শনাক্ত আর মৃত্যু গণনা ছাড়া আর কিছুই করেনি। সোমবার ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হলো। যে নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ভালো। তবে, যদি কার্যকর হয়। এর আগেও সরকার অনেক নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে সেগুলো কার্যকর হয়নি। মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম না করা, প্রত্যেক জেলা হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা করা, এগুলোও তো নির্দেশনা। কিন্তু, এগুলো তো মানা হয়নি। কাজেই সোমবারের দেওয়া নির্দেশনাগুলোও ভালো, যদি সেগুলো যথাযথভাবে মানা হয়। এখন মূল কাজই হবে এই নির্দেশনাগুলো যাতে পালন করা হয়, তা নিশ্চিত করা। কাগজে লিখে প্রকাশ করলেই তো নির্দেশনা হয়ে যায়। কিন্তু, এগুলো মানা হচ্ছে কি না, এগুলো পালনের জন্যে সরকারের কী ব্যবস্থা আছে, সেটাই দেখার বিষয়।’
‘এই নির্দেশনাগুলো যাতে যথাযথভাবে পালন করা হয়, প্রয়োজনে কঠোর অবস্থানে গিয়ে সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদি কঠোর না হয়, তাহলে এই নির্দেশনা কোনো কাজে আসবে না। মোদ্দা কথা, শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না, সেগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এক বছর পার হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত বছরের মার্চে আমাদের দেশে কিছুসংখ্যক মানুষ বিদেশ থেকে এসেছিল। কিন্তু, এখন সারাদেশে আক্রান্ত অনেকেই ছড়িয়ে আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬ হাজার ৬২০টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত আরও পাঁচ হাজার ৪২ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ জনকে পরীক্ষা করলে প্রায় ১৯ জনের করোনা শনাক্ত হবে। এখন যদি দেশের ১৭ কোটি মানুষের পরীক্ষা করা হয় তাহলে সেই সংখ্যা কত হবে? এতগুলো পজিটিভ আছে। তারা কিন্তু করোনা ছড়াচ্ছে। কাজেই এখন অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মারতে হবে। তা না করলে আমাদেরকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।’
‘প্রধানমন্ত্রী জেলা পর্যায়ে আইসিইউ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রায় চার মাস হয়ে গেছে। কিন্তু, এখনো এর বাস্তবায়ন নেই। আমি একজন সাংবাদিককে সার্ভে করতে বলেছিলাম। মাসখানেক আগে তিনি আমাকে জানান, ২৮টি জেলায় আইসিইউ পেয়েছেন। আর ৩৬টিতে পাননি। এখনো তারা জেলাতে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেনি। জেলাতে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে না পারায় রাজধানীতে চাপ বাড়ছে। এবার সংক্রমণের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা ও হার বেড়ে যাবে। বইমেলাতে ঢোকার সময় মাস্ক পরে ঢুকতে হয়। কিন্তু, ভেতরে ঢোকার পরে অনেকে মাস্ক খুলে ফেলে। তারা ভাবে যে, মাস্ক হলো বইমেলায় ঢোকার টিকিট। তাই ভেতরে ঢুকলে অনেকেই মাস্ক পরার প্রয়োজন অনুভব করছে না। মানুষের এই যে অভ্যাস, এটা করোনাভাইরাসকে সুবিধা করে দিচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ও গণপরিবহনের অবস্থাও একই। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর কথা আর না বলি। মাঝেমধ্যে সারাদেশের মধ্যে দুই-তিনটা জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিষয়টি আমরা খবরে দেখি। এ নিয়ে প্রশাসনের আর কোনো কার্যক্রম আমরা দেখি না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে এই পর্যায়ে প্রশাসনকে কঠোরভাবে মাঠে নামতে হবে।’
ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়ার বিষয়ে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও করোনায় আক্রান্ত হওয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধা আছে। এখানে বিষয়টি ভালো মতো বুঝতে হবে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কারণ, যদি বলি যে, ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেওয়ার পর কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ, তার মানে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও ১০ শতাংশের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কার্যকারিতা শুরু হতেও সময় লাগে। ওই অন্তর্বর্তীকালীন সময়েও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, ‘মহামারির জন্যে আমাদের একটি রূপরেখা আছে। রূপরেখা মানে সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলোকে প্রণীত কিছু নির্দেশনা। যেমন: কন্টাক্ট ট্রেসিং, পরীক্ষা, রোগীর চিকিৎসা, মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, শারীরিক-সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, জনসমাগম নিষিদ্ধ করা, ভ্যাকসিনেশন এই কাজগুলো। কিন্তু, এগুলোর বেশিরভাগই আমাদের এখানে মানা হচ্ছে না। চলতি মাসের শুরু থেকেই সংক্রমণ বাড়ছে। কিন্তু, সেটি নিয়ন্ত্রণে যে কাজগুলো করার কথা, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতদিন পরে এসে সোমবার সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা এসেছে। সোমবার দেওয়া নির্দেশনায় যেগুলো বলা হয়েছে, এগুলো অবশ্যই প্রয়োজনীয়। এগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। এখন কে পালন করবে বা করাবে, তাই দেখার বিষয়। কিন্তু, চলমান পরিস্থিতিতে এগুলো মানার কোনো বিকল্প নেই। এখন এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলেই হয়। এগুলো বাস্তবায়ন করলে অবশ্যই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।’
‘আমাদের এখানে এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন চলছে। এরকম চলতে থাকলে সংক্রমণ আরও বাড়বে। আর সংক্রমণ বাড়তে থাকলে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুও বাড়তে থাকবে। আমাদের এখানে ল্যাবরেটরির সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। একইসঙ্গে অ্যান্টিজেন টেস্টের আওতা আরও বাড়ানো দরকার। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই যে নির্দেশনাগুলো এসেছে, এখন জরুরিভিত্তিতে এগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এখনো সময় আছে, আমাদের যে দুর্বলতাগুলো আছে, সেগুলো কাটাতে হবে। সেটা পারলে কোভিড যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারব, তেমনি অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধিও মোকাবিলা করতে পারব। কারণ, শুধু তো করোনাই না, আরও অন্যান্য রোগও আছে। সেসব রোগে আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা তো বিঘ্নিত হচ্ছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তো সম্ভব না। আর সাধারণ মানুষকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে যাতে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে।’
প্রজ্ঞাপনে নির্দেশনাগুলো দুই সপ্তাহ কার্যকর থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এই সময়সীমা আরও বেশি করা দরকার ছিল কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে বাস্তবায়ন হোক। পরে প্রয়োজনে এই সময় আরও বাড়ানো যেতে পারে। আবার ১৮টির মধ্যে কিছু নির্দেশনা এমনও আছে যেগুলো শুধু দুই সপ্তাহ না, সব সময়েই মানতে হবে।’
Discussion about this post