অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
করোনা শনাক্তের যখন এক বছর হতে চলেছে ঠিক তখন করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা গত দুই মাসের রেকর্ড ভাঙলো। গত ২৪ ঘন্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ হাজার।
গত বছরের ৮ই মার্চ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের থেকে প্রথমবারের মত জানানো হয় বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
এর মধ্যে একজন নারী এবং দুইজন পুরুষ। এই ঘোষণার পর পেরিয়ে গেছে এক বছর।
প্রথম দিকে মানুষের ছিল উৎকন্ঠা, উদ্বেগ, ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য না থাকা, গুজব, কোন ওষুধ বা টিকা না থাকা সব মিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা। অনান্য দেশের মত জাতিসংঘের নির্দেশে মানুষের শুধু করনীয় ছিল বার বার হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
বাংলাদেশ সরকার প্রথম দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় মার্চ মাসের ১৭ তারিখে।
এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক বছরের বেশি সময় পর এখন খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার দাবি করছে অন্যান্য যেকোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এই এক বছরে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের গাফিলতি, তথ্য গোপন করা, ভুয়া পরীক্ষা জনগণকে যেমন আতঙ্কগ্রস্থ করেছে তেমনি করেছে তেমনি জীবন করেছে বিপর্যস্ত।
২২ মার্চ, বাংলাদেশ সরকার ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল যা পরবর্তীতে সাত দফা বাড়িয়ে ৩০ই মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। এছাড়া কারখানা খোলা নিয়েও বিভিন্ন সময় দ্বায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। ভূয়সী প্রশংসা পেতে দেশে ‘লকডাউন’ হলেও ক্ষমতাসীনরা ‘সাধারণ ছুটি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
‘সাধারণ ছুটি’র মধ্যে সারা দেশেই জরুরি সেবা, পণ্য পরিবহন, চিকিৎসা ইত্যাদি অতি-প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো ছাড়া গণপরিবহনও বন্ধ ছিল। দেশজুড়ে ‘লকডাউন’ করার আগ পর্যন্ত আক্রান্ত বাড়ি, প্রয়োজনে জেলা, উপজেলা ইত্যাদি লকডাউন করা হয়েছিল।
১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ২৯টি জেলা সম্পূর্ণ এবং ১৯টি জেলা আংশিকভাবে লকডাউন করা হয়েছিল।
বিভিন্ন দেশের মত দেশজুড়ে অবরুদ্ধকরণ না হলেও সারা দেশেই অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মুক্তভাবে চলাচলের উপর বাধা আরোপ করা হয়েছিল।
সারা দেশে সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বাইরে বের হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। একইসাথে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় চলাচল বন্ধের জন্যও প্রশাসন কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। কিন্তু পেটের দায়ে ছুটে চলছিলো মানুষ।
সরকারের গাফিলতি:
করোনার শুরু থেকে সরকারের কোন প্রস্তুত ছিলোনা। করোনায় যখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছিলো ঠিক তখনও মুজিববর্ষের নামে মেতে উঠেছিলো। পরে যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কর্মসূচী তুলে নিলেও করোনা প্রণোদনার নামে লুটপাটের মহাউৎসবে মেতে উঠেছিলো ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে মেম্বার সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে হাসপাতাল গুলোতে করোনা চিকিৎসার অনুমতি দিলেও চিকিৎসকের কোন সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিলোনা। এছাড়া করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে করোনা পরীক্ষা নিয়েও বিতর্ক দেখা যায়। শুধু তাই নয় করোনা চিকিৎসার জন্য অনুমদন দেয়া হয় লাইসেন্স বিহীন হাসপাতাল গুলোকে। যার কারনে ভুয়া রিপোর্ট নিয়েও বিড়ম্বনায় পড়ে সাধারণ জনগণ।
এছাড়া অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতার পরিচয়ও দিয়েছে সরকার।
করোনার তথ্য গোপন
সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর খামখেয়ালি ছিলো সবসময়। প্রাণঘাতী এই করোনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথম থেকেই বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করে আসছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম দেখানোর জন্য তারা প্রথম থেকেই টেস্ট কমিয়ে দিয়েছিল। শত শত মানুষ করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার অভাবে রাস্তায়, হাসপাতালের বারান্দায় ও অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর মারা গেছে।
তারপর আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর জন্য চিকিৎসা বাদ দিয়ে টেস্ট কমিয়ে নিয়ে আসে। করোনা হাসপাতালগুলো বন্ধ করে দিয়ে বলা হয় করোনা দেশ থেকে চলে গেছে।
সর্বশেষ তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য ভান্ডার থেকে ৮৪ হাজার করোনা রোগীর তথ্য মুছে ফেলে। জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডাটাবেজ থেকে ৮৪ হাজার করোনা রোগীর তথ্য গায়েব হয়। এনিয়ে পুরো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তোলপাড় শুরু হয়।
অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের ইনচার্জ সামসুজ্জমান গণমাধ্যমের কাছে ৮৪ হাজার করোনা রোগীর ডাটা গায়েবের বিষয়টি স্বীকারও করে।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ:
প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে যে হিসেব দেয়া হয় করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সারাদেশে সর্দি, কাশি ও জ্বর নিয়ে যারা মারা গেছে, তাদের সবাই করোনায় আক্রান্ত ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় হাসপাতালগুলো মৃত্যুর আগে তাদের পরীক্ষা করেনি। আর মৃত্যুর পর যাদের নমুন সংগ্রহ করা হয়েছে সবগুলোর রিপোর্ট পজেটিভ আসলেও প্রকাশ না করে উল্টো নেগেটিভ বলে প্রচার করছে ক্ষমতাসীনরা। এই চিত্র গুলো যখন গণমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করে তখনই বন্ধ করে দেয়া হয় ব্রিফিং।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো-প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা চাপা দিতে শেখ হাসিনা এবারও দেশের সব গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরেছে। গণমাধ্যমগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে অঘোষিত নোটিশ দেয়া হয়েছে।
গণমাধ্যমের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে তথ্য দেয়া হবে, গণমাধ্যমগুলোকে শুধু সেটাই প্রকাশ করতে হবে। কোনো গণমাধ্যম যদি করোনায় আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা নিয়ে সরকারি হিসাবের বাইরে কোনো সংবাদ প্রকাশ করে তাহলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সরকারের এই গোপন নির্দেশনা পাওয়ার পরই গণমাধ্যমগুলো করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে অতিরিক্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ছর্দি, কাশি বলে প্রচার করা হচ্ছে।
সর্বোচ্চ আক্রান্তের সময়:
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের ৮ই মার্চ। এরপরের দুই মাদস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা তিন অংকের মধ্যে থাকলেও সেটা বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
দোসরা জুলাই সর্বোচ্চ ৪০১৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ধারণা করা হচ্ছিল শীতকালে ভাইরাসের প্রকোপ আরও বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। নভেম্বরে সংক্রমণের গ্রাফ কিছুটা ওপরে উঠলেও ডিসেম্বর থেকে সেটা দ্রুত পড়তে থাকে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সংক্রমণের হার তিন শতাংশের নীচে নেমে আসে, দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল তিনশ জনেরও কম। কিন্ত আবারও যেন বেড়েই চলছে। গত দুইদিনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে গত ৬ ও ৭ই মার্চ।
Discussion about this post