অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জুলুম নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট, দুর্নীতি, গুম, হত্যা, অর্থপাচার, বিচারবহির্ভূতহত্যাসহ বিভিন্ন নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলছে। এ বছরও তার বেতিক্রম ঘটেনি।
করোনা মহামারির মধ্যেও থেমে থেকেনি তাদেরে হিংস্রতা। গেলো বছরের শুরুতে মুজিববর্ষ পালনের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অনুদানের নামে অর্থ হাতিয়ে নেয় সরকার। এরপর পুরো দেশ যখন করোনা মহামারিতে বেশামাল তখনও করোনার ত্রাণের নামে টাকা, চাল চুরিসহ প্রণোদনার টাকা লুটেপুটে নিয়েছে সরকার দলীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতারা।
এছাড়া এবছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ধর্ষণবর্ষ হিসেবে। ২০২০ সালটি বছর জুড়েই নারী ধর্ষণের ঘটনা ছিল আলোচনার শীর্ষে। খবরের শিরোনামও হয়েছে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অনেক জঘন্য ঘটনা। এসব অপকর্মে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার বিষয়টি ছিল আরো বেশি আলোচিত-সমালোচিত। ধর্ষনের ঘটনায় বিচার দাবীতে রাজপথও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দফায় দফায়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নেমেছিল অনেক রাজনৈতিক দল। রাজপথের প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আওয়াজ উঠেছিল তথাকথিত ‘মুজিব বর্ষ’কে ধর্ষণের বর্ষ বানিয়ে ফেলেছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকার। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দলবেঁধে ধর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে। ধর্ষণের পর খুনের ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আন্দোলনের মুখে গত ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে বিদ্যমান আইনে সংশোধনী আনতে বাধ্য হয় সরকার। সংসদ অধিবেশন না থাকায় ’নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’-এর সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অধ্যাদেশটি জারি করেন। পরবর্তীতে সংসদের নিয়মিত অধিবেশন শুরু হলে ৮ নভেম্বর অধ্যাদেশটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০ আকারে সংসদে উত্থাপন করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধর্ষণে সেঞ্চুরি পালন করে আলোচিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতা। মানিক নামে ওই নেতাকে ধর্ষণে সেঞ্চুরির পরও শাস্তির বদলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলো তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। মানিকের পথ ধরেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ২০২০ সালে মুজিব বর্ষকে পরিণত করেছে নারী নির্যাতনের বর্ষ হিসেবে। এ বছর খবরের কাগজের প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে প্রায় প্রতিদিনই ছিলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী কর্তৃক ধর্ষণের খবর।
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনাটি ছিলো ২০২০ সালে সব মহলে আলোচিত বিষয়। মুজিববর্ষে ছাত্রলীগের নেতারা গত ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ফুঁসে উঠেছিলেন দেশের সর্বস্তরের জনগণ।
এই গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত নয়জন আসামির মধ্যে ছয়জনই স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। তারা হলেন, সাইফুর রহমান (২৮), তারেকুল ইসলাম (২৮), শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি (২৫), অর্জুন লস্কর (২৫), রবিউল ইসলাম (২৫) ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুম (২৫)।
জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে কলেজ ছাত্রাবাসের ২০৫ নম্বর কক্ষ ছাত্রলীগের দখলে ছিলো। পর্যায়ক্রমে এ কক্ষের দখল নেয় সাইফুর। এই কক্ষেই স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটায় সাইফুর ও তার সহযোগীরা। অতীতেও এই কক্ষে তারা একই ধরণের অপকর্ম করলেও ভয়ে আগে কেউ মুখ খোলেনি।
সিলেটের ওই ঘটনায় রেশ কাটতে না কাটতেই ঝড় তুলেছিল নোয়াখালির বেগমগঞ্জে এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টায় বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই ভিডিও’র ফলে দেশব্যাপি ঘৃণা ও ধিক্কারের ঝড় উঠেছিল ফ্যাসিবাদি সরকারের প্রতি। ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ওই গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানোর অভিযোগটি উঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তরা যুবলীগের স্থানীয় নেতা এবং রাতে ভোট ডাকাতির সংসদ সদস্যের সহচর হিসাবে পরিচিত। ওই নারীকে নির্যাতনের ঘটনার ৩২ দিন পর ৪ অক্টোবর দুপুরে নির্যাতনের ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল।
মাত্র গুটি কয়েক ঘটনা আলোচিত হলেও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাবে ২০২০ সালে ১৮ হাজার ২২৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার বাইরেও আরো অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে, যারা লোক লজ্জার ভয়ে কোথায়ও অভিযোগ করতে যাওয়ার সাহস পায় না।
পত্রিকার খবরে উঠে আসা ঘটনা গুলো মধ্যে ২০২০ সালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে রাতভর মা-মেয়েকে গণধর্ষণ, পটুয়াখালীর বাউফলে সংখ্যালঘু পরিবারের মা ও মেয়েকে রাতভর ট্রলারে আটকে রেখে গণধর্ষণ, সিলেটের জৈন্তাপুরে মা-মেয়ে ও খালাকে ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ, বরিশালের বানারীপাড়ায় টেম্পুচালক স্বামীকে বেঁধে নববধূকে ধর্ষণ এবং টাঙ্গাইলে ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের মতো একের পর এক বীভৎস ঘটনা ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা।
রংপুর ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে এক শিক্ষিকাকে ধর্ষণের অভিযোগটি ছিলো ২০২০ সালের আলোচিত আরো একটি খবর। রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান সিদ্দিকী রনির বিরুদ্ধে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
এর আগে রংপুর কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সাইদুজ্জামান সিরাজের বিরুদ্ধে একই কলেজের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। ধর্ষিতা ছাত্রী নিজেই লিখিত অভিযোগটি দায়ের করেছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে। তখনো বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছিল। তবে সংসদ সদস্য ছাত্রলীগ নেতার পক্ষ নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন।
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে ভোলা ভেদুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে গত ২ আগস্ট মামলা করেন এক তরুণী। তরুণী নিজেই থানায় হাজির হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অভিযুক্ত আসামী ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন হালদার।
পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো: তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক হাসান এক বিধবা নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন ওই নারী। গত ২৫ জুলাই খবরটি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক প্রকাশিত হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইনের খবরে বলা হয়, দুই সন্তানের জননীকে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক আকিব।
১২ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইনের খবর, বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বনী আমীনের বিরুদ্ধে কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা।
অবশ্য সরকারি দলের পাণ্ডাদের ভয়ভীতি ও পুলিশের চাপে অনেক ভিকটিমই ধর্ষণের ঘটনা চেপে যায়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার অভয়নগরে এক কিশোরীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।
ভুক্তভোগী ওই কিশোরী তার দুই বছর বয়সের ভাগ্নেকে নিয়ে নওয়াপাড়া পৌরসভায় বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে পৈত্রিক ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হন।
ছাত্রলীগ আর সরকার দলের কর্মীদের কারণে ২০২০ সালে নারীরা বাবা বা স্বামীর সঙ্গে থাকলেও নিরাপদ ছিল না। এ বছরটিতে ঘরও হয়ে পড়েছিল অনিরাপদ। ছাত্রলীগ, সরকারী মদদপুষ্ট প্রভাবশালী ‘দুর্বৃত্ত’ বা পুলিশের কাছেও নারীরাও ছিল অনেকক্ষেত্রে অনিরাপদ।
এছাড়া করোনাকালে মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে না খেয়ে দিন পার করছে ঠিক সে সময় স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা তো সবার সামনে এখনও স্পষ্ট। মাত্র কয়েকদিন আগে যে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে পত্র পত্রিকায় তুলকালাম, করোনা সংক্রমণ শুরুর আগের কয়েকমাসেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্বাভাবিক দামে পর্দা কেনাসহ বিভিন্ন হাসপাতালের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে নখ-দন্তহীন দুদক পর্যন্ত ১১টি মামলা করতে বাধ্য হয়েছে। সেই পর্দা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে দলীয় নেত্রীকে টেন্ডার পাইয়ে দিয়ে চিকিৎসকদের মাঝে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ পর্যন্ত কত কিছুই না ঘটে গেল।
রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি শহরে বন্দরে রাস্তার দু’ধারে কর্মহীন হাজারো মানুষ সাহায্যের আশায় শূণ্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কেউ হাত পেতে আর কেউবা লজ্জাবনত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সিগন্যালে গাড়ি থামলেই ছুটে গিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আঁকুতি করেছে- ‘স্যার কিছু খাইতে দ্যান, নইলে কোনো একটা কাজ দ্যান’। সারা বছর যখন দেশের এমন দুর্দিন ঠিক তখনই রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের পাশাপাশি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মুজিব ভাস্কর্য। এভাবেই