বর্তমান পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ আর তার অনুসারি পুলিশ কর্মকর্তারা আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকিসহ নানা ব্যাঙ্গাত্মক কটুবাক্যে ও বিষোদ্গার করছেন। আলেম-ওলামাদের শাসিয়ে চুপ থাকার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন তারা। নতুবা হাড্ডি গুড়া করে দেবেন বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন। এই বেনরিজর আহমদই ২০১৩ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান থাকাকালীন শাপলা চত্বরে গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অধীনস্ত সরকারি কর্মচারীদের সমাবেশ ডেকে আওয়ামী লীগের পান্ডার মতো আচরণ করতে দেখা গেছে আইজিপি বেনজীর আহমদেকে। তাকে অনুসরণ করে আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা অধিনস্তদের সামনে বক্তৃতা দেয়ার সময় আলেম-ওলামাদের হুমকি দিয়েছেন। এইসব বক্তব্য ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির পক্ষে গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা শেরেবাংলা নগরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ফোরামের সদস্যদের এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেই সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতোই দলীয় বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে বেনজীরকে। অদ্ভূত ভঙ্গিমায় বক্তব্যের সময় দুই-একজন ইসলামী বক্তার নাম উচ্চারণ করে নিজের পান্ডিত্য জাহির করার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় আলেমদেরকে নিয়ে মিথ্যাচার, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া এবং ইসলামপন্থী নেতাদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করেন আইজিপি। ওই সমাবেশে বেনজির আহমদসহ অন্যান্য সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় বক্তব্যের কপি ভার্সন।
সেই সমাবেশে বেনজির আহমদের বক্তব্যের ১৬ মিনিটের একটি ভিডিও পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে এরপরই কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাতও আলেমদের নিয়ে অত্যন্ত কুরুচিকর ভঙ্গিতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। আলেম-ওলামাদের হেয় করার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে বেনজির আহমদকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জানা যায়, মূর্তির পক্ষাবলম্বন করে গত ১২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ফোরাম এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এতে স্বেচ্ছায় এবং অনিচ্ছায় অনেকে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আইজিপি বেনজীর আহমেদ, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন। ২০১৮ সালের ৩০ডিসেম্বর ভোট ডাকাতির নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন এই হেলাল উদ্দিন। এছাড়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৯টি ক্যাডারের প্রতিনিধিবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
শেখ মুজিবুর রহানের মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলাকে রাষ্ট্র, সংবিধান ও দেশের মানুষের ওপর হামলা বলে মন্তব্য করেন বেনজির আহমদ।
তিনি বলেন, ‘ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রি-এশিউর করতে চাই, রাষ্ট্র অবশ্যই তাদেরকে (মূর্তির বিরোধিতাকারীদের) কঠোর হস্তে মোকাবেলা করবে।’ এভাবেই মূর্তির পক্ষে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি জোরালো মন্তব্য করেন তিনি ।
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির বিরোধীতা মানেই রাষ্ট্র বিরোধী কাজ উল্লেখ করে, আলেমদের হুমকি দিয়ে বেনজীর বলেন, রাষ্ট্র মহাপরাক্রমশালী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করবেন না। রাষ্ট্র এটা বরদাশত করবে না।
আলেমদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেন, আজকে আমরা দেখি অনেকে উল্লম্ফন করেন। মাসল ফ্লেক্সিং করেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে মাসল ফ্লেক্সিং? গো ব্যাক এন্ড সিট ব্যাক। এন্ড ট্রাই টু রিয়ালাইজ হোয়াট ইউ আর ডুইং।
আলেমদেরকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের চেষ্টা করে বেনজীর বলেন, কিছু হওয়ার আগেই ইউটিউবে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। অসত্য কথা বলতেসেন। তো কখন কোনটা হারাম, কখন কোনটা হালাল, এ ফতোয়া দিচ্ছেন। ওই এক শ্রেণির হুজুরদের কথা আমরা কিছু বুঝতে পারি না।
মূর্তির পক্ষে বক্তব্যের সময় তিনি বার বার আলেমদেরকে নানা তীর্যক ভাষায় কটূক্তি করেন।
মাদ্রাসায় ‘জাকাত দেই, চামড়া দেই’ এবং এর মাধ্যমে কিছু পড়ালেখা করে এখন ফতোয়া দেন বলেন মন্তব্য করেন পুলিশের বড় কর্তা বেনজির আহমদ। তিনি বলেন, ‘কেন তাদেরকে এসব দেই? কারণ তারা ধর্ম প্রচার করবেন। সাধারণ মানুষকে তারা ধর্মকর্মে উৎসাহিত করবেন— এইজন্য।’ অথচ এখন তারা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছেন।
তাচ্ছিল্যের সুরে জঙ্গি আখ্যায়িত করে বেনজীর বলেন, ‘কিন্তু, অনেকে দেখি রাজনৈতিক স্পেসে জায়গা নিতে চান। দেশটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মৌলবাদী চরিত্র দিতে চান। এই যে এক শ্রেণির আলেম যারা এই কাজটি করছেন কোন উদ্দেশ্যে করছেন? কিছু একটা হলেই ঢাকা শহরে জঙ্গি মিছিল। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে তো মিছিল দেখি না! তাহলে কথায় কথায় আমাদের এখানে জঙ্গি মিছিল কেন? দেশটাকে জঙ্গির চরিত্র দিচ্ছেন কেন?’
সরকার বিরোধী মিছিল, মূর্তির বিরোধীতা করাকে তিনি ‘জঙ্গি মিছিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি সম্পর্কেও মিথ্যা তথ্য দেন। অথচ কথিত আরব বসন্তের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক শাসকের পতন হয়েছে। সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন সেদেশের মুক্তিকামী মানুষ।
দেখা গেছে, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে নিরপরাধ আলেমদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা ছাড়াও, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে এই বেনজীর আহমেদ এমন কোনো মানবতা বিরোধী কাজ নেই যা করছেন না।
এই বেনজীর আহমেদ যখন র্যাবের প্রধান ছিলেন তখন শেখ হাসিনার নির্দেশে ভিন্নমতকে দমন করতে অনেক নিরীহ মানুষকে গুম ও খুন করেছেন। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের সমাবেশে তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান আরেকজন নিরপরাধ মুসলমানকে কীভাবে খুন করতে পারে?
কটূক্তির স্বরে বেনজীর বলেন, ‘ইউটিউব খুলে এক শ্রেণির হুজুর খালি ফাল পাড়েন। খালি জাম্প করেন। এক শ্রেণির আলেম সিংহাসনে বসেন। অথচ নবী মসজিদের মিম্বারের সিড়িতে বসে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।’
সমাবেশে উপস্থিত একজন পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আলেমদের আসন নিয়ে পুলিশপ্রধান কটূক্ত করেছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিলাসী জীবনযাপন, জমকালো গাড়িবহর বা নিজের (আইজিপি) বিলাসি জীবন নিয়ে কী বেনজীর মুখ খুলতে পারবেন? এটি ভন্ডামি। তার এ ধরনের কটূক্তি মূলত আলেমদেরকে ছোটো করার জন্যই।
দেশে মসজিদ বানানোর নীতিও ঘোষণা করেন পুলিশপ্রধান। তিনি বলেন, খাস জমিতে মসজিদ ও মাদরাসা বানাবেন না।
‘মাইক নিয়া বইসা গেলো। আর পরকালের ব্যবস্থা করার জন্য বছরের পর বছর চললো,’ মসজিদের জন্য অনুদান চাওয়া নিয়েও এভাবে কটূক্তি করেন গোপালগঞ্জের এই পুলিশ কর্মকর্তা। যিনি শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলে দেশে প্রচারিত।
আলেমদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি কুষ্টিয়ার এসপির:
মূর্তির পক্ষে সমাবেশ করার পর বেনজীরের বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে আলেমদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন কুষ্টিয়ার এসপি এসএম তানভীর আরাফাত। যুবলীগের এক স্থানীয় নেতার নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী হিন্দুত্ববাদী বাঘা যতীনের আবক্ষ মূর্তি ভাঙচুরের প্রতিবাদে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া মহাবিদ্যালয়ে গত ২১ ডিসেম্বর এক প্রতিবাদ সভায় তিনি আলেমদের প্রতি কুরুচির ভাষায় আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন।
আলেমদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি দিয়ে আওয়ামীপন্থী এই এসপি বলেন, ‘আমি আমার বাবার জানাজা নিজেই পড়াব। কোনো মৌলবাদীদের কাজে লাগবে না।’ অথচ, যতীনের মুর্তি ভাঙ্গার সাথে জড়িত যুবলীগের নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যেই ধরাও পড়েছেন।
বেনজীরের সুরেই আলেমদের লেখাপড়া নিয়েও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন তিনি। এসপি বলেন, ‘রাস্তার পাশে টেবিল নিয়া বসে দান নেন, কোরবানীর চামড়া দান নেন। অমুকে দান করেন। এইসব দান করে আমরা কী সৃষ্টি করছি। আমাদের টাকায় চলে আমাদের জমিতে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করে আপনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলবেন?’
আলেমদেরকে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, উল্টা-পাল্টা করলে হাত ভেঙ্গে দেব, জেল খাটতে হবে। চুপ থাকার জন্য নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, নতুবা পিয়ারে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে।
মূর্তির বিপক্ষে যাতে আলেমরা কথা বলতে না পারেন, এজন্য হুমকি দিয়ে এসপি বলেন, ‘একেবারে চুপ করে থাকবেন। চুপ করে নিজের জীবন যাপন করবেন।’
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় শেখ মুুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মাণের নামে সারাদেশে সার্বজনীন প্রচার ও প্রসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। জেলায় জেলায় শেখ মুজিবের মূর্তি নির্মাণের নামে ব্যাপক লুটপাটও করা হচ্ছে।
মূর্তির বিরোধীতা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শীর্ষস্থানীয় ও সম্মানিত আলেমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিষোদ্গার করেছেন। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এরইমধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী, ঢাকা উত্তরের মেয়র ফজলে নূর তাপস, যুবলীগের চেয়ারম্যান ও ছাত্রলীগের হিন্দু সাধারণ সম্পাদক সহ অনেকে আলেমদেরকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়েছেন। এমনকি মিথ্যা মামলা দিয়েও তাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার। আর তাদের এই হুমকি-ধামকিকে সবশেষ যোগ হয়েছেন পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ ও কুষ্টিয়ার এসপি তানভীর।
উল্লেখ্য, এর আগে শিক্ষাউপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিব্বুল হাসান চৌধুরী নওফেল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলেম সমাজকে ভাড়াটে হিসেবে আখ্যাদিয়ে তাদের ঘাড় মটকে দেয়ার হুমকি দেয়। এরপর ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ও আলেম ওলামাকে নিয়ে সন্ত্রাসীদের ভাষায় কটাক্ষ করে। দেশের আলেম সমাজকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়।