– হাসান রূহী
‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।’ এটি একটি ঐতিহাসিক প্রবাদ। স্বৈরশাসকেরা যখন জনগণের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, দাবি উপেক্ষা করে কিংবা পুরোপুরি বাস্তবতা ও গণবিমুখ হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা অব্যাহত রাখেন তখন নিরোর সাথে তুলনা করে এই প্রবাদটি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ইতিহাসে বলা হয়, রোম নগরী যখন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল তখন সেদিকে রোমান সম্রাট নিরোর কোন ভ্রুক্ষেপও ছিল না। বরং সে সময় নাকি তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।
যুগে যুগে দেশে দেশে এমন অনেক নিরোর জন্ম হয়েছে। আর বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে রোমান সম্রাটের বাঁশি বাজানোর উপমা। যাইহোক নিরোর গল্প কাহিনি বলার কোনো উদ্দেশ্যই আসলে আমার নেই।
আপনারা যারা নবীন পাঠক তাদের আমি সামান্য একটু ১৯৭৪ এ নিয়ে যেতে চাই। বিশেষ করে যারা বিজয়ের ৫০ তম বছরে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে বিজয় দিবস পালনে উল্লাসে উচ্ছাসে মেতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল দেশ গঠনে মনোযোগী হওয়া। কিন্তু শেখ সাহেবের নেতৃত্বাধীন সরকার কি সে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন? যারা সেই সময়টির সাক্ষী হয়ে এখনও আপনার আমার মধ্যে বেঁচে আছেন তাদের ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষই এক কথায় জবাব দিবেন ‘না’। কেন পারেননি? তার উত্তর ভরা সমাবেশে শেখ সাহেব নিজেই দিয়ে গিয়েছেন এভাবে- ‘আমি ভিক্ষা করে বিদেশ থেকে আনি আর চাটার গোষ্ঠি চাইটে খাইয়ে ফেলায় দেয়, আমার গরিব পায় না’। সেই আমলে ৩০৯ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্য আর ১১৬ কোটি টাকা ঋণ করে আনার পর তার দলের লোকজন কিভাবে চুরি লুটপাট করে খেয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি এই ঐতিহাসিক স্বীকারোক্তি জনসম্মুখে দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস তখন বিএনপি ছিল না, আর জামায়াতে ইসলামীও তাদের বর্তমান অবস্থানের আশেপাশেও ছিলনা। ফলে শেখ সাহেব শেখ হাসিনা আর ওবায়দুল কাদেরদের মত এসবের দায় বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে তোলার চেষ্টা না করে নিজের লোকদের ঘাড়েই তুলে গিয়েছেন। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় এদেশের জনগণ কী অবর্ণনীয় দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিলেন তার সাক্ষী হয়ে এখনও অনেকে এই জনপদে বেঁচে আছেন। ইতিহাস রচিত হয়ে আছে ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে।
ঐতিহাসিকদের মধ্যে যারা মোটামুটি গবেষণা করে বিশুদ্ধ মত দিয়েছেন, তাদের মতানুসারে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে দেড় লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে মারা যায়। আর এই দুর্ভিক্ষের ভয়াল দানবীয় প্রভাবে পরবর্তী সময়ে যারা মারা যায় সার্বিক বিবেচনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৪ লক্ষাধিক। অবশ্য সরকারি হিসেবে এ দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা বলা হয়ে থাকে ২৭ হাজার। মৃতের সংখ্যা যাইহোক, হয়তো ভাবছেন হঠাৎ করে কেন টেনে আনছি জাতির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই বেদনা বিধূর ইতিহাস! কিন্তু আমাকে যে পরিস্থিতি এই ইতিহাস টানতে বাধ্য করছে তা আমার লেখার পরবর্তী অংশে পরিস্কার হবে ইনশাআল্লাহ।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মোকাবিলা কিভাবে করা হবে এসব ভেবে যখন বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশ্বনেতাদের গলদঘর্ম অবস্থা, ঠিক সেসময়ে মহামারি মোকাবেলার কোনো প্রস্তুতি ছাড়া বিপুল আয়োজনে মুজিব শতবর্ষ আয়োজনের লক্ষ্যে সরকারি কোষাগার থেকে বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ের হিসাব মেলাচ্ছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগকারী এদেশের জনৈক নিরো। বিশ্বজুড়ে যখন ছড়িয়ে পড়েছে মৃত্যুর ভয়াল আতঙ্ক, ঠিক সে মূহুর্তে সরকারি আয়োজনে চলছিল জমজমাট মুজিববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি। যখন বিশ্বের উন্নত দেশগুলো লকডাউন ঘোষণা করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি, মহামারি মোকাবেলায় তহবিল গঠন নিয়ে চিন্তিত, তখন এদেশের নিরোর নির্দেশে সরকারি কোষাগারের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে দেশব্যাপি আতশবাজির বিকট আওয়াজ আর ঝলকানি দেখানো হচ্ছিল। তবে তাদের সে দাপুটে আয়োজন মুখ থুবড়ে পড়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনার সামনে। মহামারি মোকাবেলায় সরকার বাধ্য হয় লকডাউন ঘোষণা করতে। ঘটনা এখানে শেষ হয়ে গেলে কতই না ভালো হত এ জাতির জন্য!
কিন্তু এখানে সবেমাত্র ঘটনার শুরু। এরপর এদেশের মানুষ এত এত বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে তা আসলে এভাবে দুই এক কথায় বর্ণনা করা অসম্ভব। যারা ভালো লিখতে পারেন তাদের কাছে দাবি থাকবে ইতিহাসের বইয়ে এই নির্মম অধ্যায়ের বর্ণনা সততার সাথে তুলে রাখার।
করোনা আর লকডাউনের প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়ে দেশের লাখ লাখ মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কাজ হারিয়ে রাজধানী ছাড়তে বাধ্য হয় হাজার হাজার মানুষ। প্রবাস থেকে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হয় লাখ লাখ রেমিটেন্স যোদ্ধা। স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা তো সবার সামনে এখনও স্পষ্ট। মাত্র কয়েকদিন আগে যে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে পত্র পত্রিকায় তুলকালাম, করোনা সংক্রমণ শুরুর আগের কয়েকমাসেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্বাভাবিক দামে পর্দা কেনাসহ বিভিন্ন হাসপাতালের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে নখ-দন্তহীন দুদক পর্যন্ত ১১টি মামলা করতে বাধ্য হয়েছে। সেই পর্দা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে দলীয় নেত্রীকে টেন্ডার পাইয়ে দিয়ে চিকিৎসকদের মাঝে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ পর্যন্ত কত কিছুই না ঘটে গেল এই দেশে তার হিসেব আমরা ক’জনেই বা রাখতে পেরেছি! রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি শহরে বন্দরে রাস্তার দু’ধারে কর্মহীন হাজারো বনী আদমকে সাহায্যের আশায় শূণ্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কেউ হাত পেতে আর কেউবা লজ্জাবনত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সিগন্যালে গাড়ি থামলেই ছুটে গিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আঁকুতি করেছে- ‘স্যার কিছু খাইতে দ্যান, নইলে কোনো একটা কাজ দ্যান’।
সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় লকডাউনের কারণে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল এ এক মাসে অর্থনীতিতে ১ লক্ষাধিক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর ওই সময় কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। করোনার প্রভাবে শুধুমাত্র পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ১১৫০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্থ হয় পর্যটন খাত। প্রকাশনা খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক কর্মচারীরা আজও পর্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছে। আজও পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। অসংখ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লকডাউনের মধ্যেই বন্যা পরিস্থিতির কারণে বসতভিটা, পশু ও কৃষি ফসলের ক্ষয় ক্ষতিতে সর্বস্ব হারিয়েছে উপকূলীয় জনগণ।
এভাবে খাত অনুযায়ী খুঁজে দেখলে করোনা পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে মূলত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। তাছাড়া প্রায় সব শ্রেণী ও পেশার মানুষই কম বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। যার সঠিক বিবরণ ও হিসাব মেলাতে হয়তো কয়েক বছর লেগে যাবে। কিন্তু এত এত ক্ষয় ক্ষতি আর বিপর্যয়ের মধ্যেও সেই ‘চাটার দল’ কিন্তু একদমই হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। সরকারি ত্রাণ লুটপাটের নিত্য নতুন পদ্ধতি দেখে দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে বাকহীন হয়ে তাকিয়ে থেকেছে। একদিকে মানুষ দেখেছে অনাহারী মানুষের হাহাকার, অন্যদিকে দেখেছে আওয়ামী লুটেরাদের উচ্ছসিত লুটপাট। পত্রিকা খুললে কিংবা টেলিভিশন চালু করলেই দেখা গিয়েছে ত্রাণ লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র।
দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান কিভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছে তা বুঝার জন্য আপনাকে খুব বড় কোনো অর্থনীতিবিদ হতে হবে না। বাজারের পানের দোকানদার থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যবসায়ীর সাথে কথা বললে আপনি এর ভয়াবহতা অনুমান করতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হলো এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের আদৌ কি কোনো নজর বা পদক্ষেপ আছে? লোক দেখানো প্রণোদনা ঘোষণার মাধ্যমেই তারা দায় মুক্তির চেষ্টা চালাচ্ছে। আর? করোনার আক্রমণে নাকি কথিত মুজিববর্ষ ঠিকঠাক উদযাপিত হয়নি। তাই নিরোর আদেশে মুজিববর্ষের মেয়াদ ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত ঘোষণা করে জনগণের অর্থ তসরুপ করার নতুন পথ আবিস্কার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই মুজিববর্ষ উদযাপনের নামে দেশ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাচার করা হয়েছে কোটি কোটি ডলার। এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে মূলত বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে মুজিববর্ষ উদযাপনের নাম করে।
দেশের এমন দুর্দিনে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের পাশাপাশি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মুজিব ভাস্কর্য। ঢাকার দক্ষিণে ধোলাইপাড় মোড়ে নাকি শেখ সাহেবের এক প্রকাণ্ড ভাস্কর্য নির্মাণের জোর আয়োজন চলছে। বলা হচ্ছে এটি নাকি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অংশ। কিন্তু একটি ভাস্কর্য কিভাবে এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হতে পারে তা অবশ্য আমি ভেবে পাইনি। তবে যা দেখে অবাক হয়েছি তা হলো, করোনায় যখন সারাদেশের সাধারণ জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে লেগেছে আগুন। হু হু করে বাড়ছে বেকারত্ব। রাজপথে প্রতিদিন বাড়ছে ভিখারীর উপস্থিতি। অন্নহীন মানুষের হাহাকার যখন দেশবাসীকে ক্রমেই ভাবিয়ে তুলছে। ঠিক সে সময়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুট করে সুদূর চীন থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে বানিয়ে আনা হয়েছে শেখ মুজিবের এই প্রকাণ্ড মূর্তি। অবশ্য আলেম সমাজ এটি স্থাপনের বিরোধীতা করায় তাদেরকে কখনও দলীয় নেতাদের দিয়ে ‘ঘাড় মটকে দেবো’ কিংবা ‘মাঠে আসো খেলা হবে’ বলে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই খেলা হোক বা না হোক, জনমনে যে দখলদারদের প্রতি ঘৃনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে সে খবর কি আমাদের মহান সম্রাট নিরোর কাছে আছে!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট