অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সেসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্বের ছাত্র জসিম উদ্দিন মানিক ছাত্রলীগে যোগদান করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতাদের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে অল্প দিনের মধ্যেই মানিক জাবিতে এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতায় পরিণত হয়। ছাত্রলীগের নেতা হওয়ায় আশে পাশের দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস ইত্যাদি থেকে মোটা অংকের চাঁদা নিত জসিম উদ্দিন মানিক। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী থাকায় আশে পাশের গ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা তার নিকট জিম্মী হয়ে ছিল।
১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি ছিল শেখ মুহাম্মদ নুরুজ্জামান এবং সেক্রেটারি ছিল শামসুদ তৌহিদ কাকর। ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হওয়া আনন্দ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি কাকর। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে খুনের দায়ে বহিষ্কার হয় কাকর।
১৯৯৮ সালে ছাত্রলীগের সেই শূন্যপদে নিয়োগ পায় জসিম উদ্দিন মানিক। আগে থেকেই প্রভাবশালী মানিক সেক্রেটারি হওয়ার পর ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। তার বিরুদ্ধে যেই কথা বলে তার বিরুদ্ধে নেমে আসতো ভয়ংকর নির্যাতন। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজী এমন কোনো অপরাধ বাকী থাকেনি যা সে করে নি। তার নেতৃত্বে সেসময়ে ছাত্রলীগের হাত থেকে রেহাই পায় নি জাবির শিক্ষিকারাও।
১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে জাবিতে একটি আনন্দ উৎসব ও পার্টির আয়োজন করে ছাত্রলীগ। মিষ্টি বিতরণ, কেক কাটা ও ককটেল ফাটিয়ে আনন্দ উৎসব করে তারা। আনন্দ উৎসবে আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না। এই আনন্দ উৎসবের উপলক্ষ ছিল তাদের নেতা জসিম উদ্দিন মানিকের সেঞ্চুরি উদযাপন। আর এই সেঞ্চুরি হলো ধর্ষণের সেঞ্চুরি। সেসময় বিরোধী মতের অবস্থা এতোই নাজুক ছিল যে এই প্রতিবাদ করার সাহস কেউ পায়নি। আনু মুহাম্মদ ও রেহনুমা খানমসহ কিছু শিক্ষক শিক্ষিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কলঙ্কজনক ঘটনার বিরুদ্ধে কথা বললেও সেটি পত্রিকায় ছাপানোর হিম্মত কারো ছিলো না।
মানিকের ধর্ষনের সেঞ্চুরি উদযাপনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। মানিকের বিরোধী ছাত্রলীগের একাংশ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্ট গোপনে মানিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। এমন সময়ে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা আরো তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। চাপা উত্তেজনা ক্ষোভে পরিণত হয়। ১৭ আগস্ট ১৯৯৮ তারিখে সর্বপ্রথম জাবিতে ধর্ষণের খবর নিয়ে রিপোর্ট করে ‘মানবজমিন’।
এবার টনক নড়ে সবার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমে সব অস্বীকার করে। আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। ছাত্রলীগের ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রঐক্য নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি হয়। মানবজমিনের রিপোর্টে বলা হয়; তিনটি ছাত্রীকে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে অন্যান্য পত্রিকা আরও বিস্তারিতভাবে রিপোর্ট প্রকাশ শুরু করে। ২০ আগস্ট ডেইলি স্টার বিস্তারিত রিপোর্ট করে।
ফলে বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই বিষয়ে তদন্ত করে। তখন অনেক ছাত্রীই মুখ খুলতে শুরু করে; রিপোর্টে অন্তত বিশটি ধর্ষণ এবং তিনশো যৌন নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া বলা হয়; ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনে মানিক একটি ককটেল পার্টির আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম-বরকত হলে। সেখানে মিষ্টি বিতরণও করা হয়। আরো জানা গেল, মানিক রীতিমতো আয়োজন করে ফুল দিয়ে বাসর সাজিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ করতো।
এত শত অভিযোগ পাওয়ার পরও শেখ হাসিনা সরকারের চাপে ছাত্রলীগের ধর্ষকদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তৎকালীন ভিসি আলাউদ্দিন আহমেদ ও প্রক্টর আফসার আহমেদ। প্রক্টর আফসার আহমেদ ছিলেন নাট্যতত্ত্বের চেয়ারম্যান এবং জসিম উদ্দিন মানিকের মামা। ছাত্রঐক্য ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে নামে। প্রতিদিন মিছিল সমাবেশ করতে থাকে। ২১ আগস্ট ছাত্রলীগ ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে। মানিক সেখানে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে।
২৩ আগস্ট ১৯৯৮ তারিখে ছাত্রঐক্যের সমাবেশে হামলা করে ছাত্রলীগ। সেখানে তারা শিক্ষিকা রেহনুমা আহমেদকে লাঞ্ছিত করে। এতে আন্দোলন আরো তীব্র হয়। এদিকে ভিসি আলাউদ্দিন আহমেদ কোনোভাবেই মানিকের দোষ খুঁজে পাচ্ছিল না অথচ তার বিরুদ্ধে ভিক্টিমরা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছে। আন্দোলন, সমাবেশ, ছাত্রলীগের পাল্টা সমাবেশ চলতে থাকে। ৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষিকা লাঞ্ছনার অপরাধে জসিম উদ্দিন মানিক ও মেহেদী হাসান টিটুকে যথাক্রমে একবছর ও দুইবছরের জন্য বহিষ্কার করে।
এই ঘটনায় আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে মানিক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। তারা ছাত্রী হলে হামলা ও আন্দোলনকারী ছাত্রদের অপহরণ ও নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু তারপরও হাসিনা সরকারের চাপে পুলিশ মানিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মানিক বহাল তবিয়তে হলে অবস্থান করে।
২২ সেপ্টেম্বর ৯ জন ধর্ষককে চিহ্নিত করা হয়। ছাত্রঐক্য তাদের নাম প্রকাশ করার দাবি জানায়। অন্যদিকে ছাত্রলীগ তাদের নাম না প্রকাশের দাবি জানায়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ ধর্ষিতাদের নাম ঠিকানা প্রকাশের দাবি জানায়।
২৫ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের চাপে জসিম উদ্দিন মানিকের মামা ও প্রক্টর আফসার আহমেদ পদত্যাগ করেন। ২৬ তারিখ ১৩ জন ছাত্রলীগ নেতাকে শোকজ করা হয় এবং ২৮ তারিখ তাদেরকে সিন্ডিকেটের মুখোমুখি হতে বলা হয়। ১৩ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য হাজির হয়।
ভিক্টিমদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি ৫ জন ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে ধর্ষণের প্রমাণ পায়। তাই শাস্তি হিসেবে জাবি ছাত্রলীগ সেক্রেটারি সেঞ্চুরিয়ান মানিককে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয় আরো চার জনকে। তারা হলো শেখ মিরাদুল ইসলাম, গোলাম মোহাম্মদ ডালাস, আতিকুর রহমান নাঈম এবং নবিউল হক রনি। এছাড়া দুইজনকে সতর্ক করা হয়। বাকীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধর্ষণের নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে ছাত্রলীগ সেক্রেটারি মানিক ও তার সহযোগীদের শাস্তি দিলেও পুলিশ প্রশাসন সেঞ্চুরিয়ান মানিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে নি। তাকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার ধর্ষকদের বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত মরিয়া ছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মানিককে ইতালি পাঠিয়ে দিয়ে তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে।