বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসনকে পদদলিত করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জামিনের অধিকার বঞ্চিত করায় মাহবুবে আলমের ভূমিকা ছিল চরম বিতর্কিত। এমনকি অভিযুক্তদের মুমূর্ষু অবস্থায়ও জামিনের বিরোধিতা করেছেন তিনি। জামিন বঞ্চিত করে অনেককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন করোনায় সদ্য মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশের ইতিহাসের বিতর্কিত প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তো বটেই, এমনকি সহকর্মী আইনজীবীকেও মুমূর্ষু অবস্থায় জামিনের বিরোধিতা করে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের কারণে পুলিশের নির্যাতনে বিশিষ্ট আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন (এম.ইউ) আহমেদ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সে সময় এ নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা ও তোলপাড় হয়। আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্ট থেকে তাঁর লাশ নিয়ে মিছিল করে প্রধান বিচারপতির বাসা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এম.ইউ আহমেদের স্ত্রী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ কয়েকজনকে খুনের আসামী করে মামলাও করেন। কিন্তু তাঁর মামলা এজাহার হিসাবে গণ্য হয়নি। উল্টো এম.ইউ আহমেদের পরিবার সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন বহুদিন।
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এম. ইউ আহমেদের মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে। বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চ থেকে স্ব-উদ্যোগে জারি করা একটি রুলের শুনানী চলছিল। মানিক নিজের উদ্যোগে রুল জারি করে ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন নেতা মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে তলব করেছিলেন। কারণ, মুফতি আমিনী সরকারের সংশোধিত বিতর্কিত সংবিধানের সমালোচনা করেছিলেন। এতে সংবিধান অবমাননার অভিযোগে বিচারপতি মানিক নিজ উদ্যোগে রুল জারি করেন। এই রুলের শুনানীতে বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়েও বিচারপতি মানিক আপত্তিকর বক্তব্য দেন। এতে উপস্থিত আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেন। এনিয়ে ওই দিন আদালতে হট্টগোল হয়। এ হট্টগোলকে কেন্দ্র করেই মামলা দেয় সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষ। অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্যোগেই এ মামলা দায়ের হয়েছিল তখন। মামলার আসামী সবাই ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের বিএনপি সমর্থক আইনজীবী। এরমধ্যে এম.ইউ আহমেদও ছিলেন। মামলা দায়েরের পর ওই রাতেই (২০১১ সালের ১১ আগস্ট) আইনজীবী এম. ইউ আহমেদকেও তার সেগুনবাগিচার বাসা থেকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতার করার পর পুলিশের গাড়ির মধ্যেই তাঁর উপর নির্যাতন শুরু হয়। নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডিবির উদ্যোগে তাঁকে প্রথমে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জরুরী বিভাগে নেয়ার পর ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তাররা তাঁকে রাখতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ডাক্তারদের পরামর্শে ডিবি পুলিশ তাঁকে নিয়ে যায় সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে। সেখানে দুইদিন রাখার পর অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। ডিবির নির্যাতনে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা এম.ইউ আহমেদের জামিনের আবেদন করা হয়েছিল হাইকোর্টে। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল চরম আপত্তি দেন জামিনের বিষয়ে। অ্যাটর্নি জেনারেলের চাপের মুখে আদালত আর তাঁকে জামিন দেয়নি। কারণ বাংলাদেশের আদালত চলতো অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ইশারায়।
জামিন না পাওয়ায় তৃতীয় দিনে তাঁর অবস্থার চরম অবনতি ঘটলে ডিবি থেকে পরিবারকে বলা হয় আপনারা এখন নিয়ে যেতে পারেন। তাঁকে আপনাদের পছন্দের কোন হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে পারেন। এতে পরিবারের সদস্যরা তড়িঘড়ি তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়। নির্যাতনের শিকার এম.ইউ আহমেদকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে দুই দিন চিকিৎসার পর ইন্তেকাল করেন।
তখন স্ত্রী ছাড়াও এম.ইউ আহমেদের (৫২) মৃত্যুর জন্য সরাসরি অ্যাটর্নি জেনারেলকে দায়ী করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। মৃত্যুর এক দিন পর মালিবাগের নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল চাইলে এম. ইউ আহমেদকে বাঁচাতে পারতেন। আমরা তাঁর জামিন চেয়েছিলাম, কিন্তু তার অনড় মনোভাবের জন্যই তা সম্ভব হয়নি।”
খন্দকার মাহবুব আরো বলেন, “অ্যাডভোকেট আহমেদকে সরকারিভাবে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনার পর আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি চিকিৎসার উদ্যোগ নিন। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে এটা আপনার কর্তব্য। কিন্তু তিনি তা নিলেন না। পরে একদিন এসে বললেন- ‘আপনারা তার চিকিৎসা করান’।”
খন্দকার মাহবুব তখন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “অ্যাডভোকেট এম.ইউ আহমেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্যদের এক দিন আদালতে দাঁড়াতে হবে।”
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করায় এই খুনের দায় এড়াতে পেরেছেন গত ১২ বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এম.ইউ আহমেদের স্ত্রী সেলিনা আহমেদ এবং বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তখন সরাসরি অভিযোগ করেন, পুলিশ হেফাজতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং একজন আইনজীবী হয়েও জামিন ও যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় এম.ইউ আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশ তখন দাবি করেছিল যে গ্রেফতারের পরপরই এই আইনজীবীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।
সেলিনা আহমেদ স্বামীর এ মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় ওই দিন সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ অভিযোগটি প্রথমে গ্রহণ করলেও তা এজাহার হিসেবে লিপিবদ্ধ করেনি। এ প্রসঙ্গে বার সভাপতি খন্দকার মাহবুব বলেছিলেন, “পুলিশ অভিযোগটিকে এখনো মামলা হিসেবে নিবন্ধিত করেনি। সুপ্রিম কোর্ট খুললে বা বন্ধের মধ্যেই যে কোনোভাবে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।”
এম.ইউ আহমেদের মৃত্যুর পর তাকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে গিয়ে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন মাহবুবে আলম। সে সময় খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, সুরতহাল প্রতিবেদনকে প্রভাবিত করতেই অ্যাটর্নি জেনারেল হাসপাতালে এসেছেন।
সূত্র: আমার দেশ