হাসান রূহী
১.
গতকাল ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪ তম জন্মদিন। কিন্তু এরচেয়ে বাজে কোনো জন্মদিন তার জীবনে এসেছে কিনা তা তিনি ভেবে চিন্তে ভালো বলতে পারবেন। কারণ, গতকাল তার জন্মদিনে পত্রিকার পাতা জুড়ে বড় বড় করে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা একদিকে যেমন শুভেচ্ছা জানিয়ে মনোহরী ডিজাইনে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। অন্যদিকে তার পাশেই বড় বড় করে ছিল তার ‘সোনার ছেলেদের’ দ্বারা স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের রোমহর্ষক বিবরণ।
ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেও অঘোষিতভাবে গত কয়েক বছরে এসব গুন্ডাদের মাথায় তিনি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ঠিকই হাত বুলিয়েছেন। নিয়মিত সোনার ছেলেদের কদমবুছি গ্রহণ করেছেন। রাতের আঁধারে জনগণের ভোট ডাকাতি করিয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ইচ্ছেমত হত্যা করিয়েছেন। তাই তার জন্মদিনে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এরচেয়ে আর ভালো কী বিজ্ঞাপনই বা দিতে পারতো! বিনা খরচে এমন বিজ্ঞাপন তো চাইলেও সবাই দিতে পারে না!
২.
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।
আসক এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অথচ ধর্ষণের শতকরা মাত্র তিন ভাগ মামলার অপরাধীরা শাস্তি পায়। আসকের হিসেব মতে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ৫৯টি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন।
উপরের পরিসংখ্যান দেখলে আপনারা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারবেন যে, নারীর নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল হতে চলেছে। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। মনে মনে তাই সবাই আওড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী, ক্বওমী জননী হযরত শেখ হাসিনার হাতে যতদিন দেশ, পথ হারাবেনা বাংলাদেশ। তিনি যেভাবে সামনে থেকে একাই দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে নিশ্চিত করে বলা যায় এদেশের সোনার ছেলেদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। দেশের মানুষের উচিত ছিল করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে জেলায়, থানায়, মহল্লায় একত্রিত হয়ে লাখো কণ্ঠে একসাথে উচ্চারণ করা- ‘থ্যাঙ্ক ইউ পিএম, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’।
৩.
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিনগুলোতে রাশিয়ার জনগণের মধ্যে দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে হাসিঠাট্টা করার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছিল। খাবারের স্বল্পতা, খাবার যোগাড় করতে দিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো, অর্থনৈতিক দুর্দশা এই সবকিছু নিয়ে তখন রাশিয়ানরা কৌতুক করতো। কৌতুক আর হাস্যরস যেন দুঃখ ভোলার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের অবস্থাও এখন ঠিক তাই। মজলুম জনগণ জুলুমের প্রতিকার না পেয়ে এখন সবকিছু নিয়েই কৌতুক করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
গতকাল এক বন্ধু ঠাট্টা করে বললেন- ‘ওবায়দুল কাদের যা বলেছিল তাই তো দেখছি ঠিক! সে বলেছিল আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। ছাত্রলীগ তো তা প্রমাণ করে ছাড়লো। এমসি কলেজে যে মেয়েটাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে তার তো করোনা থাকতে পারতো। কোন কিছু পরোয়া না করে ছাত্রলীগ প্রমাণ করেছে ওরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী!’
তবে সোভিয়েত রাশিয়া আর বাংলাদেশের মধ্যে সুক্ষ্ম একটি পার্থক্য আছে। আর তা হলো রাশিয়ায় তৎকালীন সময়ে ক্ষমতাসীনরা নয়,দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কৌতুক করতো শুধু জনগণ। কিন্তু এদেশে জালিমরাও নিয়ম করে তিনবেলা কৌতুক করে। গতকাল ধর্ষকদের প্রাণের সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারাণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য্য দাবি করেছেন- ‘নারীর প্রতি খারাপ চোখে তাকানোর মতো কোনো কর্মী ছাত্রলীগে নেই।’
এই খবর পড়ার পর সারাদেশের ছাত্রলীগ নেতাদের কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? নিয়মিত ধর্ষণ করে যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা কিভাবে নারীর প্রতি খারাপ চোখে না তাকিয়ে পারবে? এটা কি সম্ভব? তাহলে উপায়! হ্যাঁ, উপায় তো একটা বের করতেই হবে। আর সে উপায়ও বালে দিয়েছে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস। এক বক্তৃতায় ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ‘স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া অন্য কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হয় তা প্রতিহত করবো।’
বাহ! জাফর ইকবাল স্যার যে চেতনার ফিল্টার আবিস্কার করে সফল হয়েছেন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই গুন্ডা সরদার সনজিত চন্দ্র। এখন থেকে ছাত্রলীগের গুন্ডাবাহিনী নারীদের ধর্ষণ করলে ধর্ষণ শেষে সেই হতভাগ্য ধর্ষিতার গায়ে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ লিখে একটা পোস্টার সেঁটে দিয়ে আসলেই কেল্লা ফতে। বাকীটা ক্বওমী জননী ব্যবস্থা করবেন এ নিশ্চয়তা দিতে পারি। এখন থেকে এই ধর্ষণ রাজ্যের ক্ষমতাধর ধর্ষকেরা জাফর ইকবাল আর সনজিত চন্দ্রের চেতনা ফিল্টারের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়ে ধর্ষণে আরও বেশি করে মনোযোগী হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট