বিনাভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারী আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্তেই গত এক যুগ ধরে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ যাবতীয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিষয়টি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রী এমপিরা। ক্রসফায়ারে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি গত ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে শেখ হাসিনা নিজেই পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন।
ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথিত বিরোধী দলীয় উপ-নেতা জিএম কাদেরের বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা সেদিন বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলাবাহিনী কথামতই কাজ করে যাচ্ছে।’ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনার আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার জন্য ওই বক্তব্যে উপদেশ দেন তিনি। তাঁর পথ ধরেই আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠতম নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু সম্প্রতি জার্মানির একটি বার্তা সংস্থা ডয়েচে ভেলের সাপ্তাহিক টকশোতে অংশ নিয়ে উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জাতীয় প্রয়োজনেই ক্রসফায়ারের মত ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ক্রসফায়ারের পর পুলিশের বয়ানে মিডিয়া রিপোর্ট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠতম নেতা আমির হোসেন আমুর বক্তব্যে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তেই ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। মানবাধিকার সংগঠন গুলোর হিসাব মতে গত একযুগে শেখ হাসিনার শাসনামলে ২৪ শ’র বেশি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে তিনি ওয়াদা করেছিলেন সরকারে যেতে পারলে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবেন। কিন্তু বন্ধ তো অনেক দূরে। বরং জ্যামিতিক হারে এটা বেড়েই চলেছে।
ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গুলোর একই বয়ান পুলিশ বা র্যাবের গণমাধ্যম শাখা থেকে মিডিয়ায় পাঠানো হয়। প্রতিটি ঘটনার বয়ানে হুবহু মিল রয়েছে। শুধু স্থান এবং ব্যক্তির নাম পরিবর্তন হয়। পুলিশের বয়ানে বলা হয়, ধৃত আসামীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে পাল্টা গুলি চালানো হয় তাদের উপর। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতিপক্ষের ওই শুধু ধৃত টার্গেট ব্যক্তিটির গায়ে গুলি লাগে। অন্যেরা নাকি আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি ফেলে পালিয়ে যায়। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর নিরাপত্তার অজুহাতে যে নাটকীয় বর্ণনাই সাজানো হউক না কেন, ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে এটা নি:সন্দেহ। আর এসব খুনে নেতৃত্ব দিচ্ছে র্যাব ও পুলিশ।
সর্বশেষ জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়েচে ভেলে থেকে প্রচারিত টকশোতে দেখা যায় আমির হোসেন আমু বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘‘জঙ্গিবাদসহ যে উচ্ছৃঙ্খলতা, মাদকতা এদেশে বিস্তার লাভ করছে এবং তাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরেও কিন্তু থামানো যাচ্ছে না৷ সেই ক্ষেত্রে যদি অন-দ্য-স্পট গুলি করা হয়, এটা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নয়, জাতীয় প্রয়োজনে করা হচ্ছে৷”
মূলত আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ফের স্বীকার করে নিলেন যে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত যাবতীয় হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই হচ্ছে। এবং এসবের সরাসরি নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা।
২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্তগত দশ বছরে র্যাব-পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হন ২০৬৩ জন। এটা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বিশাল হুমকি। এছাড়া ২০১৯ সালে প্রায় পাঁচশ জনকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রায়ই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ কুখ্যাত অপরাধী, সন্দেহভাজন বা চিহ্নিত অপরাধী মারা যায়। ২০০২ সালে বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য স্বল্পমেয়াদি অপারেশন ক্লিনহার্ট চালু হয়েছিল। ২০০৪ সালে পুরোদমে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনাকালে ‘ক্রসফায়ার’ ব্যবহার শুরু করা হয়। এর পর পরই আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের শুরু হয়।
মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এবং ‘অধিকারের’ তথ্য মতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ২০০৯ সালে ২২৯ জন, ২০১০ সালে ১২৭ জন, ২০১১ সালে ৮৪ জন, ২০১২ সালে ৭০ জন, ২০১৩ সালে ৪৫৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭২ জন, ২০১৫ সালে ১৯২ জন, ২০১৬ সালে ১৯৫ জন, ২০১৭ সালে ১৬২ জন, ২০১৮ সালে ৩৭৭ জন খুন হন। এছাড়াও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের সংখ্যাও অনেক। আর পঙ্গু বা নির্যাতন হিসেব ছাড়া।
হাসিনার পথেই আমু গং:
গত ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের সমালোচনার আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা রাখতে হবে। আমরা সমালোচনা করবো। কিন্তু যারা কাজ করেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দিয়ে শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, “আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কথামতোই কাজ করে যাচ্ছে।”
শেখ হাসিনার সেই বক্তব্যেরই যেন পুনরাবৃত্তি করলেন আমির হোসেন আমু।
শুধু আমুই নন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তা সরাসরি নির্দেশনা ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই দম্ভভরে এর পক্ষে কথা বলেছেন।
সাভারের আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এনামুর রহমান ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই একটি দৈনিক পত্রিকাকে দম্ভভরে বলেছিলেন, “সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল। এখন সব পানি হয়ে গেছে। কারও টুঁ শব্দ করার সাহস নেই। ৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি আরো ১৪ জনের লিস্ট করেছি। এখন সব ঠান্ডা।”
মন্ত্রী-এমপিদের সাথে পাল্লা দিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে প্রকাশ্যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (সম্প্রতি শিল্প পুলিশে বদলি করা হয়েছে) মোঃ মাহবুবুর রহমান ২০১৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে সুস্পষ্টভাবে বিনাবিচারে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। দম্ভভরা সেই বক্তব্য তিনি তার নিজের ফেসবুক টাইমলাইনেও পোস্ট দিয়েছিলেন। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশনেও তার বক্তব্য প্রচার করা হয়েছিলো।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারই দায়ী:
এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের মেইন রিপ্রেজেন্টেটিভ মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, “আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্তেই যাবতীয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড” হচ্ছে কি-না, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিনাবিচারে খুনের ঘটনাগুলোর পক্ষপাতহীন ও স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন। তবে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্থানীয় অনেকেই সংশ্লিষ্ট ঘটনায় জড়িত ছিলো। আমির হোসেন আমুর বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ও সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে যেসব অগণিত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার নেপথ্যে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা রয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাভারের আওয়ামী লীগের নেতা ডা. এনামুর রহমানের দাম্ভিক বক্তব্যের উদাহরণ টেনে মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে খুন করিয়েছিলেন। এসব হত্যার আদৌ কোনো তদন্ত হয়নি। বরং, শেখ হাসিনা ডা. এনামুর রহমানকে নৈশভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ‘হাসিনাদের অপরাধ’ বিচারযোগ্য:
এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের মেইন রিপ্রেজেন্টেটিভ মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান মনে করেন, ডয়চে ভেলের অনুষ্ঠানটিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও নৈশভোটের বদৌলতে জাতীয় সংসদ সদস্য পদ দখলকারী রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু ‘জাতীয় প্রয়োজনেই ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ঘটছে’ বলে প্রথমতঃ সরকারী দলের পক্ষ থেকে প্রকৃতপক্ষে স্বীকার করেছেন যে, বিনাবিচারে খুনের সংস্কৃতির সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর স্বার্থ জড়িত।
হংকং ভিত্তিক এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের এই মানবাধিকার কর্মী আরো বলেন, “সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত মানুষের জীবন ধারণের অধিকারকে জনাব আমু নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি বলেছেন, ‘‘একজন মানুষের কার্যক্রম যদি হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, একজন মানুষের কার্যক্রম যদি লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তাকে (তার) বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই৷”
কার্যকর আইনের শাসনভুক্ত দেশগুলোতে প্রকাশ্য আদালতে ন্যায়বিচারের মাধ্যমেও যেখানে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিনাবিচারে খুনের পক্ষে এ জাতীয় বর্বর যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে।
মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আরো বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এক যুগ ধরে অগণিত মানুষকে গুম ও বিনাবিচারে হত্যার মাধ্যমে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনে প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে লাগামহীন অপব্যবহার করছেন, আমির হোসেন আমুর বক্তব্যে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থায় বিচার সম্ভব না হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এই অপরাধ বিচারযোগ্য:
আশরাফুজ্জামান বলেন, তথ্যপ্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট ভিক্টিমদের উচিৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটরের অফিসের সাথে যোগাযোগ করা ও তদন্ত প্রক্রিয়া শুরুর জন্য ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করা। এতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করা যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে বিচার পাওয়া সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলো তখনও রক্ষীবাহিনী দিয়ে একইভাবে নির্বিচারে হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। ফ্যাসিস্ট এই দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে সকল প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।
তথ্য সূত্র: অমার দেশ