অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধই বলা যায়। বিশেষ করে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, চামড়াসহ সব খাতের অবস্থাই করুণ; আশার আলো দেখাচ্ছিল একমাত্র পাট। বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৬৯ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় করেছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো-এই অবস্থার মধ্যেও কথিত আধুনিকায়ণের নামে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। পাটকলগুলো বন্ধের পেছনে শেখ হাসিনা যুক্তি দেখাচ্ছেন, এগুলোকে নাকি আরও আধুনিক করা হবে এবং পাট শ্রমিকদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করা হবে।
কিন্তু শেখ হাসিনা একবার চিন্তা করেনি যে, করোনার কারণে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হচ্ছে সেখানে ২৫টি পাটকল বন্ধের কারণে কয়েক লাখ মানুষ কর্মহীনদের মিছিলে যোগ হবে।
বিএনপি ক্ষমতায় এসে লোকসানের কারণে একটি সরকারি পাটকল বন্ধ করেছিল। এটা নিয়ে বিগত ১৫ বছর ধরে বয়ান করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে নাকি খালেদা জিয়া আদমজী পাটকল বন্ধ করেছিল।
এখনতো স্বাভাবিক প্রশ্ন-শেখ হাসিনা কার পরামর্শে দেশের ২৫টি পাটকল বন্ধ করলো? হাসিনা কাকে সুবিধা দিতে এগুলো বন্ধ করলো?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের পাট শিল্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠেছিল ভারত। বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশকে সরানোর জন্য এমন কোনো কূটকৌশল নেই যা ভারত করেনি।
তারপর, শেখ হাসিনা সারাদেশকে কথিত ডিজিটাল করলেও পাটশিল্পকে আধুনিকায়ন করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিশ্বের সেরা মানের তোষা পাট উৎপাদন হলেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের সে চাহিদা কাজে লাগাতে পারছে না। কারণ বহুমুখী পণ্য তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেশিন দেশে নাই। দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু ডাইভারসিফাইড জুট প্রডাক্ট তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তারা খুব বড় আকারে উৎপাদনে সক্ষম নয়। এ দেশের জুট মিলগুলো চলছে প্রায় ৫০ বছরের পুরনো মেশিন দিয়ে। ফলে উন্নত সুতা ও ফেব্রিক পাওয়া যায় না। হাতে গোনা ৪ থেকে ৫ ধরনের ফেব্রিক আছে বাংলাদেশে। আবার ডাইং, ল্যামিনেশন ও এক্সেসরিজ সুবিধা অনুপস্থিত। প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য রিসার্চার, ডিজাইনারের অভাব। আছে দক্ষ জনশক্তির অভাব। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যখন বহুমুখী পাট পণ্য তৈরিতে ব্যর্থ তখন এ সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে ভারত।
কারণ, ভারত ৯০ দশকে এসে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ খাতের আধুনিকায়ন করা হবে। আর এটি করতে প্রযুক্তি আমদানিতে সরকারিভাবে অনুদান দেয়া হয়েছে। ১ কোটি টাকার মেশিনে সরকার দিয়েছে ৬০ লাখ টাকা। পাট পণ্যের বহুমুখী করণে প্রয়োজনীয় গবেষণার জন্য সরকারি অর্থায়নে ৩টি শায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশটিতে।
কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার এ খাতে গুরুত্ব দেয়নি। এ খাতে সংশ্লিষ্টরা সব সময় সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছে। সরকারের গুরুত্ব না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোও অর্থায়নে আগ্রহ দেখায়নি।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো- বাংলাদেশে বন্ধ হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক পাট গবেষণা কেন্দ্রটি ভারত নিজ দেশে স্থাপন করতে চায়। সে সময়ের সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকে এ আগ্রহ ভারতের টেক্সটাইল সচিব দেখিয়েছিলেন বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তখন জানানো হয়েছিল। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বন্ধ হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক পাট গবেষণা কেন্দ্রের মতোই আরেকটি কেন্দ্র ভারতে নির্মাণে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে।
এটা থেকেই বুঝা যায় যে, পাট শিল্প নিয়ে সরকার আসলে কি করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে এখন একচেটিয়া ব্যবসা করবে ভারত।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ মনে করছেন, চীনকে ধরে রাখতে গিয়ে ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক মারাত্মভাবে খারাপ হচ্ছে। আর ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতকেও দরকার আছে তার। এখন দেশের ২৫টি রাষ্ট্রয়াত্ত পাটকল বন্ধ করে দিয়ে ভারতকে একটি সুবিধা দিলেন শেখ হাসিনা।
কারণ, শেখ হাসিনার কথিত আধুনিকায়ণ যে কবে শেষ হবে সেটা নিশ্চিত না। সরকার মূলত একটি অজুহাতে পাটকলগুলো বন্ধ করেছে।