ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের শহীদ মাতুব্বর হত্যার পর দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এই মামলার প্রধান আসামি আসলাম ফকিরকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ইতিমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে আটক সাত আসামি শহীদ মাতুব্বরকে খুন করার জন্য আসলাম ফকিরকে দায়ী করেছেন।
পুলিশের দাবি, যেকোনো সময় তারা আসলামকে ধরে ফেলবে। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সাংসদ কাজী জাফরউল্যাহ আবারও আসলাম ফকিরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এর আগে অন্য এক হত্যা মামলায় আসলামের ফাঁসির আদেশ হলেও তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় রক্ষা পান। পরে বিশেষ বিবেচনায় কারাগার থেকে মুক্তিও পান। আর পুরো এই প্রক্রিয়ার পেছনে ছিলেন কাজী জাফরউল্যাহ।
এদিকে শহীদ মাতুব্বর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাত আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন, আসলাম ফকিরই এই হামলার নেতৃত্ব দেন। এই মারামারিতে অংশ নিতে তাঁদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান এবং ভাঙচুর করার নির্দেশ দেন। তাঁরা রামদা, রড, লাঠি, দিয়ে ভাঙচুর করতে গেলে শহীদ বাধা দিতে আসেন। এরপর তাঁর ওপর আক্রমণ করলে তিনি নিহত হন। পুরো ঘটনায় আসলাম ফকিরই হুকুমদাতা ও অপরাধী।
ঘটনার দুই সপ্তাহ পরেও স্বামীর খুনের মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শহীদ মাতুব্বরের স্ত্রী সাজেদা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই। আসলাম ফকির খুন করবে আর এভাবে বেঁচে যাবে! কেউ তাকে কিছু বলছে না। আমি শুনেছি, এই খুনের আসামি দিনের বেলায় গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই তাকে দেখেছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরছে না।’ সাজেদা আরও বলেন, ‘এখন আমার সংসার কে চালাবে? কে আমার তিন সন্তানকে দেখবে? আমার তো মাথার ছাদটাই নেই। গরিব মানুষ বলে কি আমাদের প্রাণের কোনো দাম নেই?’
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান অবশ্য বলেছেন, আসলামকে তাঁরা যেকোনো মুহূর্তে ধরে ফেলবেন। মামলা হয়েছে, তাই পালিয়েছেন।
এই মামলার বাদী শহীদ মাতুব্বরের চাচা শাজাহান মাতুব্বর আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছেন বলে জানান।
এদিকে ১৪ দিন পার হতে চললেও শহীদ মাতুব্বরকে হত্যার প্রধান আসামি আসলাম ফকিরকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পরিবার বলছে, দিনের বেলায় গ্রামে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাঁকে খুঁজে পাচ্ছে।
এখনো আসলাম ফকিরকে পুলিশ কেন গ্রেপ্তার করতে পারল না, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘দেখুন, আমি পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি। তিনি কোনো অপরাধীকে ছাড় না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আসলাম ফকির যত বড় প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানের কাছের লোকই হোন না কেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে। তাঁকে খোঁজা হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করুন।’
এ বিষয়ে ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুর রহমান বলেন, আসলাম ফকির আত্মগোপনে আছেন। তিনি জেলখাটা আসামি। অত্যন্ত ধূর্ত। নিজের মুঠোফোনটিও বাসায় স্ত্রীর কাছে রেখে গেছেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে তিনি নিজেকে অনেক ক্ষমতাবান মনে করেন।
ফরিদপুরের পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর আসলাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর কাছের লোক হিসেবেই তিনি এলাকায় পরিচিত। ওই আসনের স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিত বর্তমান সাংসদ মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) সমর্থকদের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয় বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় লোকজন জানান, গত ২১ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটায় লক্ষ্মীপুর গ্রামে বৃষ্টির সময় টিনের পানি আরেক বাড়িতে পড়া নিয়ে আবারও দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরপর আসলাম ফকির ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে একই এলাকার শাজাহান মাতুব্বরের সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে আসলাম ফকিরের লোকজন শাজাহান মাতুব্বরের সমর্থক শহীদকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন। শহীদ পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে মারা যান।
ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সাংসদ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহর সঙ্গে এলাকার নানা কর্মসূচিতে দেখা গেছে আসলাম ফকিরকে। এবারও কাজী জাফরউল্যাহ আসলাম ফকিরকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ ও এলাকাবাসী।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের আসলাম ফকির ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যা করেন। এ মামলায় আসলাম ফকিরের মৃত্যুদণ্ড হয়।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে খুনের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসলাম। কিন্তু তা নামঞ্জুর হয়। দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে তা গৃহীত হয় এবং আসলামের দণ্ড কমিয়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ। কিন্তু সে সময় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ১৩ বছর ২ দিন কারাভোগের পর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম।
সূত্র: প্রথম আলে