অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
প্রাণঘাতী করোনার বিস্তার নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। সরকার সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ থেকেই সার্বিক পরিস্থিতি বুঝা যায়। শুধু এতটুকু বলা যায় যে, করোনা পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর পরিস্থিতি এ পর্যায়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ সরকারের খামখেয়ালি, অব্যবস্থাপনা।
দেশে করোনা মোকাবেলায় যারা সামনের কাতারে আছেন তাদের মধ্যে ডাক্তার ও নার্সরা হলেন অন্যতম। তারা সরাসরি করোনা আক্রান্তদের কাছে থেকে তাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বলা যায়-জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা এখন কাজ করছেন।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ডাক্তারদের সুরাক্ষার জন্য এখন কিছুটা ব্যবস্থা করলেও নার্সদের সুরক্ষার জন্য সরকার এখন পর্যন্ত কিছুই করেনি। বরং তাদের সুরক্ষা দেয়ার কথা বলে হাসপাতালে এনে এখন কিছুই দিচ্ছে না। এছাড়া হাসপাতাল গুলোতে নিম্নমানে মাস্ক দেওয়া হচ্ছে। এমনকি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও দেওয়া হচ্ছেনা।
খাদ্য সংকটে নার্সরা, বাস্তবায়নে নেই সরকারি পদক্ষেপ
জানা গেছে, সম্প্রতি কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের একজন নার্স হাসপাতালের কর্মীদের খাদ্যসংকট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। এরপর পোস্টটি ভাইরাল হলে বেসরকরি একটি চ্যানেলে উঠে আসলে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এরপর বিভিন্ন মহল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর চাপ সৃষ্টি হলে তারা নার্সদের জন্য হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার আশ্বাস দেন। তাদের আশ্বাসের পর নার্সরা আবার হাসপাতালে কাজে যোগ দেন।
জানা গেছে, আবাসিক হোটেলে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও, নানা অজুহাতে তাদের এখনও সেখানে ঠাঁই হয়নি। দিনরাত রোগীদের সেবা দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তাদের রাত্রিযাপন করতে হচ্ছে হাসপাতালের ফাঁকা ওয়ার্ড, কেবিন, পোশাক বদলানোর কক্ষ ও ডরমেটরিতে। অনেকের রাতে ঘুম না হলেও ভোরে উঠে ডিউটিতে যেতে হচ্ছে।
তারপর, তাদের জন্য উন্নতমানের খাবার সরবরাহের প্রতিশ্রুতি থাকলেও আলাদা কোনো বাজেট নেই, এমন অজুহাতে রোগীদের জন্য বরাদ্দ বাজেট থেকে রান্না করা খাবারই নার্সদের তিন বেলা খেতে দেয়া হচ্ছে। তাদের জন্য সরবরাহকৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীও (পিপিই) নিম্নমানের। শুধু তাই নয়, নার্সদের জন্য নেই এন-৯৫ মাস্ক। সাধারণ যে মাস্ক দেয়া হচ্ছে তাও নিম্নমানের।
কুর্মিটোলা হাসপাতালের একাধিক নার্স গণমাধ্যমকে জানান, কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আমরা বাসা থেকে কাপড়-চোপড়সহ নিত্য ব্যবহার্য সব জিনিস নিয়ে ৪-৫ দিন আগে হাসপাতালে চলে আসি। আমাদের জন্য ডিউটি শেষে হাসপাতালের অদূরে রিজেন্সি হোটেলে রুম বুক করা হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও সেখানে নেয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
তারা আরও জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখে শুনেছি, করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত নার্সরা থাকবেন শুনে ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। পরে জানতে পারি গুলশানের একটি হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এখন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না।
নার্সরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত নার্সদের সমস্যা দেখার জন্য নার্সিং অধিদফতর থেকে করোনা সেল গঠিত হলেও, সেলের কেউ তাদের খোঁজ নেন না। তাদেরকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায় না।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাওয়া নার্সদের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক এভাবেই প্রতারণা করে যাচ্ছেন।
গণমাধ্যমের সঙ্গে নার্সদের কথা বলা বন্ধ
এদিকে খাদ্য সংকট নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে মানা করেছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার ১৫ এপ্রিল এ–সম্পর্কিত নোটিশটি জারি করেন।
চিঠিতে বলা হয়, ‘নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের আওতাধীন সব সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীকে সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জনসমক্ষে, সংবাদপত্রে বা অন্য কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা, বিবৃতি বা মতামত প্রদান না করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
নার্সিং পেশার সঙ্গে যুক্ত একজন জ্যেষ্ঠ নার্স বলেন, সম্প্রতি কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের একজন নার্স হাসপাতালের কর্মীদের খাদ্যসংকট নিয়ে একটি পোস্ট দেন। তাঁর ওই পোস্ট ও বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। নার্স নেতারা এ নিয়ে হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে পড়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর চিঠি ইস্যু করে।
সূত্রমতে, এই চিঠির উদ্দেশ্য হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কোনো চিত্র যেন নার্সদের মাধ্যমে বাইরে প্রকাশ না পায়।
এই নোটিশ থেকেই বুঝা যাচ্ছে, সরকার নার্সদের জন্য কোনো ভাল ব্যবস্থা করছে না, আবার এসব নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলতে দেবে না।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ মনে করছেন, এসব থেকে সরকারের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রকাশ হয়েছে। এসব ঢাকতেই এখন নার্সদেরকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
চিকিৎসকদের জন্য নিম্নমানের মাস্ক পাঠাচ্ছে সরকার
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যবহারের জন্য একটি কার্টনে করে এসেছে এক হাজার মাস্ক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এই কার্টনের গায়ে লেখা এন-৯৫ মাস্ক। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা কার্টন খুলে মাস্ক দেখে চমকে যান। কারণ ভেতরে পাওয়া যায় নিম্নমানের কাপড়ের মাস্ক।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকটি কার্টনে এসব মাস্ক আসে। ওপরে এন-৯৫ মাস্ক লেখা থাকলেও ভেতরে কাপড়ের নিম্নমানের মাস্ক পাওয়ায় হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। এমন ঘটনা সম্পর্কে কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পাচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমি নিজে কার্টন খুলে মাস্ক দেখে চমকে গেছি। কাপড়ের তৈরি মাস্কগুলো খুবই নিম্নমানের। গেঞ্জির কাপড়ের মাস্ক। এগুলো ব্যবহার করে রোগীদের কাছে যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা।’
নাম প্রকাশ না করে আরেক চিকিৎসক বলেন, ‘এমন ঘটনা আরেক বিভাগের একটি হাসপাতালে ঘটেছিল। হাসপাতালের প্রধান প্রতিবাদ করলে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। এ জন্য চিকিৎসকেরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারছেন না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নূরুন নাহার মুঠোফোনে বলেন, এ পর্যন্ত কোনো এন-৯৫ মাস্ক পাওয়া যায়নি। কার্টনের গায়ে এন-৯৫ লেখা, কিন্তু পাওয়া গেছে কাপড়ের মাস্ক। এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না, ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।