অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
নিখোঁজের প্রায় দেড় বছর পর ফিরে এসেছেন সাবেক র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান। গতকাল রাত ১২টার দিকে রাজধানীর নিজ বাসায় ফেরেন তিনি। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। তিনি ফিরে এসেছেন এতেই অনেক খুশি তার পরিবার। হাসিনুরকে আজ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তার স্ত্রী শামীমা আক্তার।
২০১৮ সালের ৮ই আগস্ট ডিবি কর্তৃক নিখোঁজ হয়েছিলেন হাসিনুর। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুরের ডিওএইচএস এলাকা থেকে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার দেড় বছর পর ফিরে এসেছেন তিনি। কিন্তু এখনও ফেরেনি অনেকেই। ক্ষমতাসীন সরকারের গত দশ বছরে (২০১৮-১৯) প্রায় ছয়শ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই এখনো হদিস মেলেনি।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায় ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ২৬ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৬৬ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৮৬ জন, ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত ৫৫ জন।
এর মধ্যে র্যাব ১৫২ জনকে, পুলিশ, ৫১ জনকে, ডিবি পুলিশ ১৫৫ জনকে, র্যাব-ডিবি পুলিশ যৌথভাবে ১২ জনকে, অন্যান্য সংস্থা ৯৮ জনকে এবং বাকীদের বিষয়টা নির্দিষ্ট করা যায়নি।
গুমের পর নির্যাতন ভোগ করে অল্প কয়েকজন যারা ফিরে এসেছেন তারা চুপ হয়ে গেছেন। কারা গুম করেছিল, কেন গুম করা হয়েছিল, গুম করে কোথায় তাদের রাখা হয়েছিল সে ব্যাপারে ভয়ে তারা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারছেন না। হাসিনুরেরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এতোদিন তিনি কোথায় ছিলেন, কীভাবে ছিলেন কিছুই বলতে পারছেন না তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগ্রেডিয়ার আবদুল্লাহিল আমান আযমী।২০১৬ সালের ২২ আগস্ট বিগ্রেডিয়ার আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে বাড়ি থেকে ফিল্মি স্টাইলে উঠিয়ে নিয়ে যায় সাদা পোষাকের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁর আর কোন খবর নেই। এ নিয়ে কারো তেমন কোনো মাথাব্যাথাও দেখা যায়নি। তৎকালীন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ছিল একেবারেই নীরব। বরং সত্যকে আড়াল করে অনেক বিভ্রান্তিকর সংবাদ তখন প্রচার হয়েছে।
তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো আমান আযমী ফিরে আসেননি। পরিবার তাকিয়ে রয়েছে প্রয়াত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্র হুম্মামের মতোই একদিন ফিরবেন সেই আশায়। বার বার প্রশাসন, রাষ্ট্রের কাছে স্বজনরা দৌঁড়ঝাপ করেও কোন লাভ হয়নি।
একই সময়ে জামায়াতের সাবেক নেতা মীর কাসেম আলীর ছোট ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমানকেও গুম করা হয়। রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাকেও তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুম করা হয় বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে। আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। একই বছরে ৪ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে বাস থেকে নামিয়ে গুম করে র্যাব। দুই ছাত্র ওয়ালীউল্লাহ ও মুকাদ্দাসের আজ পর্যন্ত কোন খোঁজ মেলেনি। চৌধুরী আলমের পরিবার জানেনা কোথায় আছে তাদের পরিবারের বটবৃক্ষ। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ কিংবা নিরীহ সুখরঞ্জন বালির পরিবার জানেনা কবে দেশে ফিরতে পারবে তাদের অভিভাবক।
এছাড়া ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে নিখোঁজ হন কানাডার ম্যাকগ্রিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ (২০)। তিনি ঢাকায় ছুটিতে এসেছিলেন।
এরপর একই বছরে মিরপুর ডিওএইচএসের ১০ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির সামনে থেকে আইটি বিশেষজ্ঞ কামরুল হাসান (৩১) অপহূত হন। পরদিন তাকে বিভিন্নস্থানে থাকা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় খোঁজাখুঁজি করেন তারা। এরপর তারা র্যাব ও ডিবি পুলিশের কার্যালয় এবং ঐ এলাকার থানায়ও খোঁজ করেন। কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে তিনি পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
আতাউর রহমান শাহীন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস ফ্যাক্টরির আইটি শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক। ২০১৯ সালের গত ২ মে সকালে অফিসে কাজে যোগ দেন। সেখান থেকে তিনি সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে বের হন। সেখান থেকে তিনি নিখোঁজ হন। ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করলে এখনো হদিস মেলেনি।
এভাবে বলতে থাকলে ঘটনার পরিক্রমা শেষ হবার নয়। পুলিশ সদরদপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে গত দশবছরে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৭৪৫২টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৮০০ জন, ২০১০ সালে ৮৮১ জন। ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে ৮৭০ জন করে অপহৃত হয়েছে। ২০১৪ সালে ৯২২ জন, ২০১৫ সালে ৮০৬ জন, ২০১৬ সালে ৬৩৯ জন, ২০১৭ সালে ৫০৯ জন, ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ২৮৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছে।
এভাবে সন্তান, স্বামী, বাবাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কেটে যাচ্ছে হাজারও পরিবারের দিন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সে পরিস্থিতির বাস্তব কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া এই মানুষগুলো আদৌ কোনোদিন ফিরবে কিনা কেউ আজও পর্যন্ত বলতে পারছেনা। তবে এতোদিন পরে হাসিনুরের ফিরে আসায় আবারো প্রিয়জনের ফিরে আশার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছেন পরিবার।