প্রবাসী আয় ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ তাদের আশঙ্কা, এখনই সতর্ক না হলে মন্দার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷
বাংলাদেশে এখন রপ্তানি এবং আমদানি বাণিজ্যের সূচক নিম্নমুখী৷ বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে৷ লেনদেনের ভারসাম্যও কমছে৷ কমছে বেসরকারি ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি৷ ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়ছে৷ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালেচনা করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগ নয়, ৬ ভাগ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ অর্থনীতি পড়তে পারে মন্দার কবলে৷ এটা বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির জন্য নয়, আমাদের কারণেই হচ্ছে৷ বাইরের মন্দার প্রভাব শুধুমাত্র আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে পড়ছে৷’’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে৷ অক্টোবরে ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম৷ আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আর সেপ্টেম্বরে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ কম হয়েছে৷ চলতি অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই থেকে অক্টোবর) গড় হিসেবে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশ৷
গত জুলাই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার৷ আগস্ট শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৯ কোটি ডলার৷ আর সেপ্টেম্বর শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলারে৷
সেপ্টেম্বর মাস শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি৷ গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহতভাবে কমছে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ৷
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ শতাশ কম৷ গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কমে যাওয়া মানে হলো বিনিয়োগ কমছে৷ কমছে উৎপদন৷ ফলে আমাদেরর রপ্তানিও কমছে৷ ব্যাংকখাতের অবস্থা খুবই খারাপ৷ খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে৷’’
তার মতে, আমদানি, বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি কমা খারাপ অর্থনীতির লক্ষণ৷
এ পরিস্থিতিতে তার আশঙ্কা, ‘‘পোশাক রপ্তানিতে আমরা আমাদের অবস্থান আর ধরে রাখতে পারব বলে মনে হয় না৷” তার মতে, পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করা হয়নি, ‘‘অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য আমরা কি করেছি? সুশাসনের জন্য আমরা কি করেছি? দুর্নীতি বন্ধ হয়নি৷ দেশের টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে৷’’
সবচেয়ে বেশি গেছে এই জেলা থেকে৷ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা থেকে মোট ৬ লক্ষ ১৯ হাজার ১৩৮ জন বিদেশ গেছেন, যেটা রপ্তানি হওয়া মোট জনশক্তির প্রায় ১০.৯৪ শতাংশ৷
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘যদি আমাদের শিল্প উৎপাদন বাড়তো, তাহলে তো ভ্যাট বাড়তো৷ আমাদের রাজস্ব আয় হতাশাব্যঞ্জক৷ আয়কর খাত থেকেও রাজস্ব বাড়ছে না৷ সরকার ঋণ করছে৷ সেই টাকায় যদি শুধু বেতন দেয়া হয় তাহলে তো পরিস্থিতি খারাপ৷ বড় বড় ঋণ খেলপি ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে৷ আটকে যাচ্ছে মাঝারি এবং ছোট আকারের খেলাপিরা৷ আমার কথা হলো তাদের সুযোগ দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখুন, বড়দের ধরুন৷ তারা আসলে লুপপাটের সাথে জড়িত৷’’
তবে বাংলাদেশ এখনো রেমিটেন্সে ইতিবাচক ধরা ধরে রাখতে পেরেছে৷ সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ৷ আর অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ৷ অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
এ প্রসঙ্গে নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘শুধু প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করে তো আর পুরো অর্থনীতি চলবে না৷ পোশাক খাতে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির ধাক্কা লাগছে৷ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক সূচকের নিম্নগতি৷ এখনই আমরা সতর্ক না হলে আমাদের অর্থনীতির বড় ধরনের সংকট হতে পারে৷’’
আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, ‘‘এখন বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন৷ সেটা না করলে আমরা মন্দায় পড়ে যেতে পারি৷ আমার কাছে যে হিসাব রয়েছে তাতে অর্থনীতির সূচকগুলো এখন খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে৷’’
সূত্র: ডয়েস ভেলে