অবশেষে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান শুরু করতে যাচ্ছে সংগঠনটির আরেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের বিরুদ্ধেও, যিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী। এছাড়া দুদকের এবারের অনুসন্ধানে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শতাধিক শীর্ষ নেতা।
রোববার (১৭ নভেম্বর) বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) পাঠানো চিঠিতে এ অনুরোধ করে দুদক। একই সঙ্গে সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। আজ সোমবার এ তথ্য জানা গেছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, ছাত্রলীগের তিন নেতাসহ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ছাত্রলীগের এই তিন নেতার বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান চলছে তা নয়, সব মিলিয়ে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের হুইপসহ চারজন সংসদ সদস্য, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পাঁচ কাউন্সিলরসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন।
দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানকে তদারক কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়।
অনুসন্ধান দলের প্রাথমিক তদন্তের ফল হিসেবে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপ্রদর্শিত ও অবৈধ সম্পদের তথ্য হাতে পেয়েছে দুদক। সে তালিকা অনুযায়ী, এবার অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে তদন্ত দলের প্রধান সৈয়দ ইকবাল হোসেন বা দুদকের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে এর আগে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, দুদকের অনুসন্ধান দল কাজ করছে। অনেকেরই নাম এসেছে। বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি গণমাধ্যমে আসা নামগুলোও সংগ্রহ করে অনুসন্ধান দল কাজ করছে। তালিকা বড়-ছোট না, যাদের নামে অভিযোগ আসছে, তার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অভিযুক্ত অবৈধ সম্পদ ও মুদ্রাপাচারের বিষয়টি দুদকের এখতিয়ারভুক্ত। অনুসন্ধানে তথ্যপ্রমাণ মিললে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হবে। তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কমিশন মামলা করবে।
দুদকের অনুন্ধান দলের তালিকায় চারজন বর্তমান ও একজন সাবেকসহ পাঁচজন সংসদ সদস্যের নাম রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী, বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু ও তার স্ত্রী সায়মা আফরোজ এবং সাতক্ষীরার সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান।
তালিকায় থাকা ঢাকা সিটির কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীব, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মঈনুল হক মঞ্জু।
তালিকায় রয়েছে- ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম সিদ্দিকী ও গোলাম রাব্বানী এবং ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম সোহেলের নাম।
এছাড়া যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, তার স্ত্রী শেখ সুলতানা রেখা, ছেলে আবিদ চৌধুরী, মুক্তাদির চৌধুরী ও ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সহসভাপতি সরোয়ার হোসেন মনা, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন স্বপন, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, তার স্ত্রী সানজিদা রহমান, যুবলীগ নেতা গাজী সরোয়ার বাবু, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সহসভাপতি মুরসালিক আহমেদ, তার মা আছিয়া বেগম, বাবা আবদুল লতিফ ও স্ত্রী কাওছারী আজাদ, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা কামরান প্রিন্স মোহাব্বত, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমান, যুবলীগ নেতা আতিয়ার রহমান দীপু, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান হোসেন খান, সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক তসলিম উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক কায়সার আহমেদ, যুবলীগ ঢাকা উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে বাপ্পীর নামও রয়েছে দুদকের তালিকায়।
দুদক সূত্র জানায়, তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন মিয়া, ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাশেদুল হক ভূঁইয়া, ঢাকার ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বাতেনুল হক ভূঁইয়ার নাম।
আর আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার, তার স্ত্রী পারভীন সুলতানা, মেয়ে নুজহাত নাদিয়া নীলা, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কে এস মাসুদুর রহমান, তার বাবা আবুল খায়ের খান, মা রাজিয়া খান, স্ত্রী লুৎফুন নাহার লুনা, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজের নামও রয়েছে দুদকের তালিকায়।
পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও নাদিমের সম্পদেরও অনুসন্ধান করবে দুদক।
এর আগে দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানকে তদারক কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরই অংশ হিসেবে ৩০ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন অবৈধ ক্যাসিনো ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। দুদক ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে ৩০ সেপ্টেম্বর। এজন্য পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক। পরে আরও দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় দলে। ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৪টি মামলা করেছে দুদক।
তথ্য সূত্র: বাংলানিউজ ও জাগো নিউজ