– হাসান রূহী
ইদানিংকালে দেশের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে দু’টি আদালতের কর্মকান্ড আমাকে বেশ আন্দোলিত করে। এর একটি উচ্চ আদালত, অপরটি জনগণের আদালত। এমন এমন বিষয় ইদানিং এই দু’টি স্থানে আলোড়ন সৃষ্টি করছে, যে অনেক সময় তা আপনার মাথার অন্তত কয়েক হাজার কিলোমিটার উপর দিয়ে চলে যাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় দেশে উৎপাদিত পাস্তুরিত দুধের কথা। আর সে উদাহরণের জন্য একটু সংবাদ পরিক্রমা দেখাতে চাই। আশা করি পাঠক ধৈর্য্যচ্যুত হবেন না।
২৫ জুন ২০১৯ এর খবর: বাজারের প্রচলিত দুধে উদ্বেগজনকহারে এন্টিবায়োটিক, ফরমালিন ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি
২৮ জুন ২০১৯: খাদ্যপণ্যের মান নিয়ে শিক্ষকদের গবেষণা, ঢাবির অস্বীকার
২৮ জুলাই ২০১৯: ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ
৩০ জুলাই ২০১৯: প্রধানমন্ত্রী: হঠাৎ করে এক প্রফেসর সাহেব কী পরীক্ষা চালালেন
এই খবরের একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। হাইকোর্ট দুধে ভেজাল, এন্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি দেখে ১৮ কোম্পানির দুধ বিক্রি স্থগিত করে দেয়ার একদিন পরেই প্রধানমন্ত্রী বললেন- ‘আমি জানি না হঠাৎ করে একজন প্রফেসর সাহেব কী পরীক্ষা করে বলে দিলেন, দুধ ব্যবহারযোগ্য নয়। তা নিয়ে আদালতে রিট করা হয়। বলে দেওয়া হয় দুধ ব্যবহার করা যাবে না।’
সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি এখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক অত্যন্ত সিনিয়র ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ। একদল দক্ষ গবেষক নিয়ে দুই দফা পরীক্ষা চালিয়ে তিনি পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। সেসব পরীক্ষার প্রতিবেদন আমলে নিয়েই আদালত ১৪ টি কোম্পানীকে দুধ বিক্রি বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশের সাথে সাথে বদলে যায় আদালতের নির্দেশ! পরের দিনেই খবরের শিরোনাম-
১১টি কোম্পানির দুধ উৎপাদন ও বিক্রিতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত!
আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে শুধু এতটুকু বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর সামান্য অসন্তোষ প্রকাশেই যদি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বদলে যায়, তবে তা অতি সামান্য হলেও দৃষ্টিকটূ।
এবার চলুন জনগণের আদালতের দিকে নজর দেয়া যাক। সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী ব্যরিস্টার রুমিন ফারহানা ও জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবিরের খাস কামরা সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমটা আজকাল অনেকটা জনগণের আদালতে পরিণত হয়েছে। আর এখানেই জনগণ এখন অনেক কিছুর বিচার বিশ্লেষণ করে ফেলছে। যদিও এটি সবক্ষেত্রে সুখকর নয়। কিন্তু এ আদালতকে ঠেকানোও যে সম্ভব নয়!
‘দলের নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পক্ষে কথা বলার জন্য সংসদে যাচ্ছি’ এমন কথা বলে ভোট ডাকাতদের সংসদে সংরক্ষিত আসনের এমপি হয়েই সরকারের কাছে ১০ কাঠা জমি চেয়ে বসলেন বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা। সাথে সাথে স্পষ্টভাবে এটাও জানালেন যে, এই ১০ কাঠা জমির বরাদ্দ পেলেই তিনি রাতের আঁধারে যারা জনগণের ভোট লুটেছে তাদের কাছে ‘চির কৃতজ্ঞ’ থাকবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা এদেশের জনগণকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে জোরেশোরে প্রচারের চেষ্টা করছেন। কারণ হিসেবে তারা বলতে চাচ্ছেন- যে দেশের স্বাধীনতার জন্য শেখ সাহেব নিজেকে উৎসর্গ করলেন, সেই দেশের জনগণই নাকি তাকে অকৃতজ্ঞের মত হত্যা করেছে। সেই কথিত ‘অকৃতজ্ঞ’ জাতি কিভাবে রুমিন ফারহানার এই ‘চিরকৃতজ্ঞ’ থাকাকে ভালো চোখে দেখবেন?
রুমিন ফারহানা হয়তো ভাবছেন সমস্যাটা সেখানেই। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। দেশের মানুষ ইস্যুর ভীড়ে অনেক ইস্যু ভুলে যায়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি সবকিছু ভুলে যাবে? অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর জনগণকে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের কাঁচকলা দেখিয়ে ক্ষমতায় থেকে আবারও নির্বাচনের মূলা ঝুলিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে থাকার পরেও শেষ পর্যন্ত সে অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় বিরোধী দলগুলো। আর সেই সুযোগ নিয়েই মন ভরে জনগণের ভোট ডাকাতি করে আ. লীগ। জনগণের সাথে আ. লীগের এই নির্মম প্রহসনের দগদগে ঘা তাজা থাকতেই যে রুমিন ফারহানা সেই প্রহসনকারীদের কাছে মাত্র ১০ কাঠা জমি বরাদ্দ পাওয়ার লোভে ‘চিরকৃতজ্ঞ’ থাকার অঙ্গীকার করে বসবেন তা কে জানতো! হয়তো তিনি জনগণের পালস্ বুঝতে ভুল করেছিলেন। কিন্তু সময় নিয়ে হলেও তিনি অবশেষে জনগণের পালস্ বুঝে সেই জমি বরাদ্দের আবেদন প্রত্যাহার করেছেন।
প্রশ্ন হলো, রুমিন ফারহানা যে আবেদন করেছিলেন সেটি কোনো প্রকাশ্য বিষয় ছিল না। পুরোপুরি একটি দাপ্তরিক বিষয় ছিল। সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে রুমিন এই আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সরকারি দপ্তরের এমন টপ সিক্রেট তথ্য কিভাবে ফাঁস হয়ে গণমাধ্যম হয়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেল? কয়েকদিন আগে এক চায়ের আড্ডায় আমার জনৈক বন্ধু এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলে জবাবে অপর বন্ধু বললো- ‘যে দেশে ডিসির খাসকামরার রতি-ক্রিয়ার ভিডিও ফেসবুকে ঘুরে বেরায়, সে দেশে একটা আবেদন পত্র ফাঁস হওয়া আর এমন কঠিন কি?’
সততা ও নৈতিকতার বিপর্যয় হতে হতে দেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন আর এ দেশে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এখানে রাজনীতিবিদরা যেমন অসৎ আর চরিত্রহীন। সেই রাজনীতিবিদরা যেসব আমলা আর সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ দেন তারাও অসৎ এবং চরিত্রহীন। সকলে নয়, অধিকাংশ। সারাদেশেই অনৈতিকতা চর্চার হিড়িক পড়ে গেছে। সেটা পাস্তুরিত দুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানী, সাংসদ কিংবা আমলা। কেউ কারো থেকে যেন পিছিয়ে থাকতে চাইছে না।
এই নৈতিকতার বিপর্যয় রোধে জনগণকে সচেতন হতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সততা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। এই লড়াইয়ে জিততে হবে। অনৈতিকতা আর চরিত্রহীনতার বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে নৈতিকতা ও সচ্চরিত্রের প্রকান্ড দেয়াল। অন্যথায় আগামীর প্রজন্মের জন্য আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট