বাংলাদেশে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে ২৪ ঘন্টায় ৩ জন নিহত হয়েছেন৷ আর ১৪ দিনে নারীসহ নিহত হয়েছেন ৫ জন৷ রবিবারও দেশের চারটি এলাকায় গণপিটুনির খবর পাওয়া গেছে৷ তবে কেউ নিহত হননি৷
শনিবার উত্তরবাড্ডায় একটি স্কুলের সামনে ‘ছেলেধরা সন্দেহে’ গণপিটুনিতে নিহত এক নারীর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ ত্রিশোর্ধ ওই নারী তাঁর সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে দাবি করেছিলেন৷ কিন্তু উত্তেজিত জনতা তা মানেনি৷ এক পর্যায়ে তাঁকে গণপিটুনি দেয়া হয় এবং সেই নারী মারা যান৷
কয়েক সপ্তাহ আগে ‘পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানো হয়৷ গত বৃহস্পতিবার নেত্রকোণায় এক যুবকের ব্যাগে একটি শিশুর বিচ্ছিন্ন মাথা পাওয়া যাওয়ার পর পরিস্থতি আরো জটিল আকার ধারণ করে৷ এছাড়া প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়ানোর ঘটনাও ঘটছে৷
এ পর্যন্ত ঢাকাসহ সাত জেলায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে৷ এতে ৫ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন৷ শুধুমাত্র নেত্রকোণার ঘটনা ছাড়া আর সব ঘটনায় গুজবের কারণে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগীরা৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রসফায়ারেরই আরেক রূপ হলো গণপিটুনি৷ বিচারহীনতা ও পুলিশের নিস্ক্রিয়তার জন্যই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ তবে যারা ক্রসফয়ারে উল্লসিত হন তারাই এখন গণপিটুনিতে আতঙ্কিত৷
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গণপিটুনির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা জারি করা হলেও তাতে কাজ হচ্ছেনা৷ গণপিটুনি বা গণপিটুনি দিয়ে হত্যা ফৌজদারী অপরাধ৷ কিন্তু সেই আইনকে আমলে নিচ্ছে না উত্তেজিত জনতা৷ যারা গণপিটুনির শিকার হয়ে আহত বা নিহত হচ্ছেন তারা অধিকাংশই সাধারণ ও নিরীহ মানুষ৷ তারা সন্দেহের বশে গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন৷ এনিয়ে সারাদেশে দেখা দিয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা কিছুদিন আগে দেখলাম প্রকাশ্যে হত্যা করছে (বরগুনায়), মানুষ এগিয়ে আসছেন না৷ আর এর বিপরীতে দেখছি মব ভায়োলেন্স৷ এই দু’টির সামাজিক ও মানসিক কারণ আছে৷ মানুষ যখন পুলিশের প্রতি, বিচারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে তখন নিজে নিজে একটা বিচার বসায়৷ সিদ্ধান্ত নেয় যে এই মানুষগুলো অপরাধী এবং তাদের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিতে হবে৷ একে বলে লিন্সিং৷ আর এটা যখন সঞ্চারিত হয় তখন মানুষ বিবেকবোধ হারিয়ে যায়৷ এর সুযোগও নেয় কেউ কেউ৷ লেভেল করে দিয়ে বা গুজব ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে উত্তেজিত জনতার রোষে ফেলে দেয়৷”
তবে যারা এই গণপিটুনির শিকার হন তারা নিরীহ বা সাধারণ মানুষ না হয়ে যদি সশস্ত্র হতো, তাহলে এই পরিস্থিতির শিকার হতো কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজী বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘যেদেশে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে নাশকতা করা হয়, সেদেশে গুজব যে কত কার্যকরী তা সহজেই বোঝা যায়৷ আর পদ্মা সেতু নিয়ে যে গুজব ছড়ানো হয় তার পিছনেও আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য৷ তবে অধিকাংশ ঘটনাই ঘটছে পুলিশের নিস্ক্রিয়তা ও বিচার না পাওয়ার কারণে৷”
গণপিটুনির ঘটনায় পুলিশকে নিস্ক্রিয় দেখা গেছে৷ ৯ জুলাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পুলিশ তিন যুবককে আটকের পর তাদের কাছ থেকেই ‘ছিনিয়ে’ নিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত লোকজন৷ গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে এক আটক আসামিকে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা কর গ্রামবাসী৷
অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘‘পুলিশ নিজেও গণপিটুনির শিকার হয়৷ তাই নিজের জীবন বাঁচাতে তারা অনেক সময় গণপিটুনিতে সহায়তাও করে৷ এখান থেকেই বোঝা যায় পুলিশ ও বিচারের প্রতি আস্থাহীনতা কোন পর্যায়ে গেছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘গণপিটুনির যে কারণ ক্রসফায়ারের মধ্যেও কিন্তু একই জিনিস নিহিত৷ মানুষ যখন ক্রসফায়ারে নিহত হয়, একটা বিরাট অংশের মানুষ এটাকে সমর্থন করে৷ আমরা এটাকে বলি আয়রনি৷ গণপিটুনিতো ক্রসফায়ারেরই আরেক রূপ৷ আমাদের মানসিকতাকে মানবিক করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যা করা দরকার তা হচ্ছেনা৷”
সূত্র: ডয়েচ ভেলে