হাসান রূহী
অগ্নিকান্ডের কাছে রাজধানীর মানুষগুলো কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে তা বিশেষভাবে কোনো বিশ্লেষণের দাবি রাখে না। পুরান ঢাকার নিমতলী কিংবা চকবাজার থেকে শুরু করে অভিজাত বনানী পর্যন্ত আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া বা বিপদগ্রস্থ মানুষকে উদ্ধার করতে যে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে এসে হাজারও পেশায় যুক্ত হয় মানুষ। কিন্তু সেই মানুষকে নিরাপদ কাজের পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গতকাল বনানীর এফ আর টাওয়ার যদি আরও একটি রানা প্লাজা, তাজরীন কিংবা স্পেকট্রাম হতো তবে তার ভয়াবহতা দেখে হাহুতাশ করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিল না। সরকারি সংস্থার দেয়া তথ্য মতে এফ আর টাওয়ারে মৃতের সংখ্যা ২৫। বাস্তবিক অর্থে তা কতজন আল্লাহ ভালো জানেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করতেই হয় যে, বড় ধরনের বিপদ থেকে তিনি আমাদের হেফাজত করেছেন। ২২ তলা এই টাওয়ার ভেঙে পড়লে কিংবা পুরোটাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়লে এ সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
সে যাইহোক, আজ কলম ধরেছি উৎসুক জনতার উদ্দেশ্যে। যারা কিছু ঘটার সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এটি একটি মানবিক স্বভাব। কোন বিপদাপদ কিংবা দুর্যোগ-দূর্ঘটনার খবর শুনে ছুটে যাওয়া সম্পূর্ণ একটি মানবিক ব্যাপার। এতে দোষের কিছুই দেখি না। কিন্তু ছুটে যাওয়ার উদ্দেশ্য যদি হয় ফেসবুক লাইভ করা, ছবি, ভিডিও ধারণ কিংবা সেলফি তোলা, তাহলে তো অবশ্যই দোষের কিছু আছে।
মিডিয়ার উপর দখলদার সরকারের কড়া নজরদারির কারণে সামাজিক মাধ্যম আমাদের দেশের জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এমন অনেক তথ্য ও খবর রয়েছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঠিকই ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় দেখা যায় যে, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার কারণে গণমাধ্যম ওই ইস্যুটি আর এড়িয়ে যেতে না পেরে খবর প্রকাশ করে। কিন্তু এই ভাইরাল হওয়া যদি কারও নেশায় পরিণত হয়, অথবা মানবিক দায়িত্ব পালনে অনীহা সৃষ্টি করে তাহলে তার ফলাফল হতে পারে অত্যন্ত ভয়াবহ।
বনানী এফ আর টাওয়ার অগ্নিকান্ডের অনেক মর্মান্তিক ছবি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক ছবি ও ভিডিওর ভীড়ে কিছু ছবি দেখে যথেষ্ট হতাশ ও মর্মাহত হয়েছি। দূর্ঘটনা ঘটলে দূর্গত মানুষের সহায়তা করতে যদি ছুটে যাওয়া যায় তবে এরচেয়ে মহৎ কিছু আর হতে পারে না। কিন্তু কেউ যদি দূর্ঘটনার খবর শুনে ফটোসেশন, মিডিয়া কভারেজ, কিংবা ফেসবুক লাইভ দিতে ছুটে যান তাহলে তা মানবতার সাথে এক নির্মম কৌতুক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। ছবিতে দেখলাম বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের হাতগুলো উঁচু করে রেখেছেন। কিন্তু সে হাতগুলো সাহায্যের হাত ছিল না। তাতে দেখা যাচ্ছিল শত শত স্মার্টফোন। ছোটবেলায় গ্রামে কোথাও আগুন লাগার খবর পেলে গ্রামের মানুষকে দেখতাম যে যা পেরেছে তাই নিয়ে ছুটে যেত। বালতি, কলস, ঘড়া, ঘটি, দা, কাচি, খোন্তা… মোট কথা যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া যাকে বলে। কিন্তু একি! সভ্যতায় ঘেরা শহরে মানুষ ছুটে এসেছে ঠিক, সবার হাতে একই জিনিস, স্মার্টফোন। স্মার্টফোন দিয়ে কি আগুন নেভানো যায়? তবে কেন এই অদ্ভূত আচরণ!
সবাই যে একই কাজ করেছে তা বলবো না। কিছু বিবেকবান তরুণকে দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিরলস কাজ করে যেতে। ছোট্ট একটি শিশুকেও দেখেছি জীবনের সকল শক্তি দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের হোসপাইপের ছিদ্র হয়ে যাওয়া অংশ চেপে ধরতে। আরও অনেকেই অনেকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আগুন নেভাতে স্মার্টফোন নয়, প্রয়োজন পানি, বালু। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের বনানীর আগুন নেভাতে যখন হিমশিম অবস্থা। বারবার শেষ হয়ে যাচ্ছিল পানি। উৎসুক মানুষের ভীড় ঠেলে যাতায়াতে বেগ পেতে হচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্স ও পানির গাড়িগুলোকে। ঠিক সে সময়ে যারা তারুণ্য ভরা হাত উচিয়ে স্মার্টফোন ধারণ করেছেন, তারা যদি এক বোতল করে পানি নিয়ে এসে পানির গাড়ির ট্যাংকে ঢেলে দিতেন কতই না ভালো হতো! যদি তারা আশে পাশে কোথাও থেকে শক্ত কাপড় বা ত্রিপল সংগ্রহ করে সবাই মিলে লাফিয়ে পড়া মানুষগুলোকে বাঁচাতে এগিয়ে যেতে পারতেন তবে হয়তো বেঁচে যেতে পারতো আরও কয়েকটি প্রাণ।
দূর্ঘটনার খবর সকলকে জানানোর দরকার। সাহায্য চাওয়া দরকার। যখন গণমাধ্যম সরাসরি লাইভ টেলিকাস্ট করছে, তখন উৎসুক জনতার লাইভ করার যৌক্তিকতা খুবই নগণ্য। তাই আসুন দূর্ঘটনা দেখলে স্মার্টফোন নয়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমরা এগিয়ে আসি। মানুষ মানুষের জন্য। জীবন জীবনের জন্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট