সোহরাব হাসান
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৬৯ জন মানুষ মারা যাওয়ার পর ব্যর্থতার দায় নিয়ে দুই সাবেক শিল্পমন্ত্রীর পারস্পরিক দোষারোপটি ‘উন্নয়নের রোল মডেল সরকারের’ জন্য একটি অদ্ভুত নিদর্শন হয়ে থাকতে পারে।
পয়লা সুযোগে এই দুই সাবেক শিল্পমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হয় তাঁদের অকপট সত্য ভাষণের জন্য। তাঁদের একজন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, আরেকজন নিজের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিজের সাফাই গাওয়ার পাশাপাশি একে অপরকে চরম ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ইতিমধ্যে দেশবাসী ভালো করেই জেনে ফেলেছেন, তাঁরা কেউ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরাতে বলার মতো কিছু করেননি।
এ রকম দোষারোপ বিএনপি-জামায়াত বা চারদলীয় জোট থেকে এলে নিশ্চয়ই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির মিথ্যাচার ও অপপ্রচার বলে শোরগোল তুলতেন। কিন্তু মুশকিল হলো, সাবেক দুই শিল্পমন্ত্রী স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিশালী দুই স্তম্ভ। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। আর তাঁর পূর্বসূরি দিলীপ বড়ুয়া ১৪-দলীয় জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক। কম কেউ নন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে গঠিত সরকারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। অন্যদিকে ২০১৪-২০১৮ মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আমির হোসেন আমু। দিলীপ বড়ুয়া শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে নিমতলী ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারায় ১২৪ জন নারী-পুরুষ ও শিশু। আর আমির হোসেন আমু শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে গোবিন্দগঞ্জের চিনিকলের জমি উদ্ধারের নামে সাঁওতালদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এযাত্রায় প্রথমে মুখ খোলেন দিলীপ বড়ুয়া। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ভবন দেখতে গিয়ে ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম নেতা দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘সদ্য বিদায়ী শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু সিরিয়াস হলে হয়তো এত দিনে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরানো সহজ হতো, কেমিক্যাল ব্যবসা স্থানান্তর করার জন্য আমি মন্ত্রী থাকাকালে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
অভিযোগের জবাবে আমির হোসেন আমুও কম যাননি। গত সোমবার দিলীপ বড়ুয়ার উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা সরাতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতেই সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া আবোলতাবোল বকছেন। নিজের ব্যর্থতা আড়াল করতে তিনি অগ্রিম এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুই জাঁদরেল মন্ত্রীর বয়ান থেকে থলের বিড়ালটি বেরিয়ে এল। বোঝা গেল, তাঁরা কেউই তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেননি। এখন দুই মন্ত্রীর মধ্যে কার মেয়াদে কে বেশি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, গজফিতা দিয়ে সেটি মাপতে বসেছেন দুজন।
যখন দেশে সত্যিকারের ‘বিরোধী দল’ ছিল, তখন দেখেছি, সরকারের কোনো মন্ত্রী কোনো বিষয় কথা বললে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হতো। আবার বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নালিশ এলে সরকারের মন্ত্রী বা মুখপাত্র তার উত্তর দিতেন। কিন্তু এবারে ঘটল বিস্ময়কর ঘটনা। সরকারি জোটের দুই সাবেক মন্ত্রীই বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। ক্ষমতার হাত বদল হলে পরের সরকার বলে আগের সরকার সব ধ্বংস করে গেছে। নতুন সরকারকে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদল হয়নি। বদল হয়েছেন মন্ত্রী। তাই আগের সরকারের ওপর সব দোষ চাপানোর সুযোগ না থাকায় এখন দুই সাবেক একে অন্যকে বেশ ঘায়েল করতে শুরু করেছেন। তা–ও এমন সময়ে, যখন চকবাজারে মানুষ কয়লা হয়ে গিয়েছে। হাসপাতালে হাসপাতালে তাঁদের স্বজনেরা আহাজারি করে চলেছেন।
রোম যখন পুড়ছিল, তখন নাকি সম্রাট নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। আমাদের সদাশয় দুই সাবেক নিরোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনলেন। আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েই তাঁরা ক্ষান্ত হননি, কার রাজনৈতিক জোর কত কম, কে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ক্ষমতা রাখেন না—সেসব মহামূল্যবান তথ্যও সামনে নিয়ে এসেছেন।
দিলীপ বড়ুয়া তবু ১৪ দলের প্রতিনিধি হিসেবে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। কিন্তু সাবেক শিল্পমন্ত্রী হিসেবে আমু সেখানে একবার যাওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি।
বিরোধী রাজনীতিকদের সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের অশ্রদ্ধা প্রদর্শন কিংবা ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে বিরোধী দলের নেতাদের বিষোদ্গার শুনতে আমজনতা অভ্যস্ত। কিন্তু একই জোটের শরিক এক সাবেক আরেক সাবেককে যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন, তা কোনো ভদ্রতার সীমারেখার মধ্যে থাকেনি। মোক্ষম ভঙ্গিতে তোপ দেগে আমু বলেছেন, দিলীপ বড়ুয়া যে দলের নেতা, সে দলের কোনো নেতার নাকি ইউপির চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা নেই। আমরা বোকা জনগণ শুধু অবাক হয়ে ভাবছি, ইউপির চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতাও যাঁর নেই, আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন কী করে? জনাব আমু কি তখন দলীয় ফোরামে আপত্তি তুলেছিলেন?
আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মন্ত্রী একে অপরকে দায়িত্বহীন, অথর্ব ও অযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়ে কার্যত নিজেদের ব্যর্থ বলেই স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, মন্ত্রীরা যদি ব্যর্থ হন, সরকার সফল কী করে।
সূত্র: প্রথম আলো