অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধকে ইস্যু করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করলেও বাস্তবে আওয়ামী লীগ কতটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে? রাজনীতির ময়দানে ঘুরে ফিরে প্রায়ই এই প্রশ্ন আসে আমাদের সামনে।
যুগ যুগ ধরে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে আসলেও আওয়ামী লীগ বরাবরই অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে বিএনপি জামায়াতের দিকে। কিন্তু এর বাস্তবতা কতটুকু?
বাস্তবতা হল এই যে, আওয়ামী লীগ মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই এই অস্ত্র ব্যবহার করে। যার কোন ভিত্তি নেই। জামায়াতে ইসলামীতে কোন মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা অথবা ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিতর্কিত রায়ে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের সন্তানরা নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে পারবে কিনা- এই অযৌক্তিক বিতর্ক সৃষ্টির পেছনে যারা, চলুন দেখে নেয়া যাক সেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রাপ্তদের মধ্যেই কতজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সন্তান রয়েছে!
১। (ফরিদপুর– ৩) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন:
ফরিদপুর– ৩ আসনের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কুখ্যাত রাজাকার ছিলেন। তিনি শান্তি বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার জন্য হানাদার বাহিনীকে প্ররোচিত করেন। “দৃশ্যপট একাত্তর: একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ” বইয়ের ৪৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন শান্তি কমিটির জাদরেল নেতা ছিলেন। তার পিতা নুরুল ইসলাম নুরু মিয়া ফরিদপুরের কুখ্যাত রাজাকার ছিলেন।
২। (চাঁদপুর ১) মহিউদ্দীন খান আলমগীর:
চাঁদপুর-১ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহে অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছেন। তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ সময় আরেফিন রচিত “মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইয়ের ৩৫০ পৃষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত বাঙালি অফিসারদের তালিকা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তাকে চিহ্নিত রাজাকার হিসেবে আখ্যা দিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি তার বিচার দাবি করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।
৩। (ময়মনসিংহ ৬) অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন:
ময়মনসিংহ ৬ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহবায়ক ডা. এম এ হাসানের দেয়া যুদ্ধাপরাধের তালিকায় (ক্রমিক নং-৭৩) উল্লেখ করা হয়েছে। যা পরবর্তীতে ঐ মাসেরই ২২ এপ্রিল দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ দিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্বে ২০১২ সালের ৬ এপ্রিল ফুলবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও জোড়বাড়িয়া গ্রামের ওয়াহেদ আলী মণ্ডলের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে ময়মনসিংহের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিট্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন।
৪। (রংপুর ৫) এইচ এন আশিকুর রহমান:
রংপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক এইচ এন আশিকুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের অধীনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে টাঙ্গাইলে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তিনি পাকিস্তান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন। এস এস এম শামছুল আরেফিন রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যক্তির অবস্থান’ বইয়ের ৩৫০ পৃষ্টায় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের তালিকায় তার নাম প্রকাশিত হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে বলেন, রাজাকার আশিকুর রহমান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ বলে তার বিচার করবেন না তা হয় না। মন্ত্রীসভায় রাজাকার রেখে রাজাকারের বিচার করা যায় না।
৫। (গোপালগঞ্জ ১) লে.কর্ণেল (অব) ফারুক খান:
পর্যটন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক খান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের পক্ষে দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহীনীর পক্ষে প্রথম অপারেশন চালান এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। সুত্র: “দিনাজপুরের মক্তিযুদ্ধ” বই।
৬। সৈয়দ জাফরউল্লাহ:
আওয়ামী লীগের প্রেসেডিয়াম সদস্য সৈয়দ জাফরউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে কাজ করেছেন। মাসিক “সহজকথা” আয়োজিত যুদ্ধাপরাধের বিচার: বর্তমান প্রেক্ষাপট শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ জাফরঊল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। জাফর উল্লাহ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের পূর্ণ সমর্থন দেন। “মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান” বইয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
৭। (ঢাকা-২) অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম:
ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম রাজাকার পরিবারের সদস্য। তার বড় ভাই হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম নেজামে ইসলামি পার্টির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করার জন্য তার নেতৃত্বেই ঢাকায় প্রথম শান্তি কমিটি গঠন হয়। একই সঙ্গে তিনি রাজাকার, আল বদর ও আল শাসম বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর পাশাপাশি মু্ক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বড় ভাইকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার রাজাকার ভাইয়ের মালিকাধীন প্রিন্টিং প্রেসে তিনি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন।
৮। (বরগুনা-২) শওকত হাচানুর রহমান:
বরগুনা-২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হাচানুর রহমান। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় যুদ্ধাপরাধীর সন্তানদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। অথচ তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা খলিলুর রহমান বরগুনায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
৯। (সিলেট ০৩) মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস:
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফেঞ্চুগঞ্জ-দক্ষিন সুরমার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের বাবা ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, এমন তথ্য প্রকাশ করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট থেকে প্রকাশিত ‘রণাঙ্গন-৭১’ নামক স্মারক গ্রন্থ। সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘রণাঙ্গন-৭১’ নামক সেই গ্রন্থে সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের বাবাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েলের সম্পাদনায় প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থটিতে আওয়ামী লগের সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের বাবা শেখ মুজিব সরকারের আমলের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন পিরু মিয়াকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১০। (জামালপুর-৩): মির্জা আজম:
জামালপুর–৩ আসনের সংসদ সদস্য, যুবলীগের লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকার দলীয় হুইপ মির্জা গোলাম আযমের বাবা ১৯৭১ সালে মির্জা কাশেম জামালপুরের মাদারগঞ্জে শান্তি কমিটির জাদরেল নেতা ছিলেন। তিনি রাজাকার, আল-বদরদের গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। তার বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণ ও লুটপাটের একাধিক অভিযোগ আছে। যা “জামালপুরের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮১ সালের সংস্করণ)” বইয়ে উল্লেখ আছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আ. লীগের এমপি মন্ত্রী ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য- জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সাবেক পরিবেশ ও বন মন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মাওলানা নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে্র যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতা বিরোধীতার শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যারা মুখে ফেনা তোলে সেই আ. লীগেরই বাস্তব অবস্থা হলো এই। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে এত দহরম মহরম সম্পর্ক থাকার পরেও আওয়ামী লীগ তার বিরোধী পক্ষকে রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি তকমা লাগাতে একটুও দেরি করে না।
মূলত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই আওয়ামী লীগ বার বার মুক্তিযুদ্ধকে টেনে আনে। আর এদিকে জনগণকে ব্যস্ত রেখে বাস্তবায়ন করে ভিনদেশী আধিপত্যবাদীদের এজেন্ডা। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের সে মুখোশ উন্মোচিত। এখন শুধু জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পালা।