ইইউ সম্পর্কে গতকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি ভুয়া। ‘বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচনে সক্ষম’- এমন কোনো কথা ইইউ’র পক্ষ থেকে বলা হয়নি। এই মন্তব্যটি মূলত SADF ডেলিগেশন নামে একটি ইউরোপিয়ান থিংকট্যাংকের। যারা ইইউর সাথে সাউথ এশিয়ার সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করে।
প্রথম আলো, কালেরকণ্ঠ, ঢাকা ট্রিবিউনসহ প্রায় সবগুলো জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকায় ইইউর নামে এই ভুয়া নিউজটি প্রকাশিত হয়েছে। এর সূত্রপাত করেছে মূলত রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস। জাতীয় পত্রিকাগুলোও সত্যতা যাছাই না করেই বাসসের নাম দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেছে।
“বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম : ইইউ” শিরোনামে বাসসের এ সংক্রান্ত খবরে যা বলা হয়েছে তার প্রথমাংশ এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো-
“ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল বলেছে, বাংলাদেশ সরকার আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে সক্ষম।
নগরীর একটি হোটেলে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের রক্ষণশীল সদস্য রুপার্ট ম্যাথুস বলেন, বাংলাদেশের রাজননৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে যতটুকু জেনেছি তাতে আমি আস্থাশীল, এই দেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
তিনি বলেন, আসন্ন এই নির্বাচনে ইইউ পার্লামেন্ট কোন পর্যবেক্ষক পাঠাবে না কারণ, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বিশ্বাস করে বাংলাদেশ নিজের মতো করেই নির্বাচনী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভালোভাবেই প্রস্তুত।
বাজেট বরাদ্দ না থাকায় ইইউ পার্লামেন্ট পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না এই ধারণা নাকচ করে ম্যাথুস বলেন, ইইউ পার্লামেন্ট পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাইলে এ বিষয়ে তারা বাজেট বরাদ্দ দিত।
তিনি বলেন, ইইউ পার্লামেন্ট মনে করে বাংলাদেশ নিজস্ব আইনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম। তাই আমরা পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রয়োজন মনে করছি না।
বিশ্বব্যাপী নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ইইউ পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের মতামত অনুযায়ী বাংলাদেশ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে।
ম্যাথুস বলেন, তার দল সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনগণসহ বাংলাদেশের অনেক লোকের সাথে আলাপ আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সামাজিক, নারীর ক্ষমতায়ন ও সংখ্যালঘুসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে আমরা এখানে এসেছি।
পর্তুগীজ পার্লামেন্টের সদস্য জোয়াও পেদ্রো গুইমারেস বলেন, তার দেশ ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে।
সফরটি বাংলাদেশ সম্পর্কে এই ভুল ভেঙে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি এ দেশ সত্যিই চমৎকার।”
বাসসের এই বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনটিই সবগুলো পত্রিকায় হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, আলোচ্য প্রতিনিধিদল প্রকাশ্যে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করলেও শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধম্যগুলো তাদের প্রতিবেদকদের বরাতে খবরটি প্রকাশ না করে বাসসের বরাতে প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস এই প্রতিনিধিদলকে ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল’ হিসেবে উল্লেখ করলেও ইউরোপীয় একটি থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ভিন্ন কথা বলছে। একই সাথে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ‘পার্লামেন্টারি ডেলিগেশন’ বা ‘পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল’ যেভাবে গঠন করা হয় তার সাথে এই প্রতিনিধিদলের ধরণ মিলছে না।
South Asia Democratic Forum (SADF) হচ্ছে ব্রাসেলস ভিত্তিক একটি থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান, যেটি ইউরোপীয় ইইউনিয়নের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ও এখানকার বিভিন্ন গণতান্ত্রিক গোষ্ঠি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে। আলোচ্য প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে গত রোববার প্রকাশ করা হয়।
Future generations should not suffer as our’s did’: PM Sheikh Hasina dreams of a prosporous Bangladesh শিরোনামের প্রতিবেদনে আলোচ্য প্রতিনিধিদলের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটির এক যায়গায় বলা হয়েছে-
“the Brussels-based South Asia Democratic Forum (SADF) organised the visit of a high level European delegation comprising of Parliamentarians and officials visited Bangladesh from November 23-25.”
অর্থাৎ, ইউরোপিয়ান থিংকট্যাংক সংস্থা SADF এর আয়োজনে এই প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে এসেছে, যাতে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একাধিক সদস্যের সাথে SADF এর কর্মকর্তা এবং অন্যরা ছিলেন। বলা-ই বাহুল্য যে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতের ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া ব্যক্তিবর্গের নামই SADF এর ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে।
SADF-ও তাদের রিপোর্টে প্রতিনিধিদলটিকে ‘(high level) European delegation’ বলছে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত (ভুল) তথ্যের মতো করে ‘’ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল’ বা ’European Parliamentary delegation’ বলেনি।
কোনো প্রাইভেট সংস্থার আয়োজনে কোথাও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যরা ভ্রমণ করলে তা ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল’ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো পার্লামেন্টারি ডেলিগেশন (প্রতিনিধদল) গঠিত হতে পারে না। এবং একই কারণে তাদের কোনো বক্তব্যকে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য’ হিসেবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের তিন ধরনের পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের গঠন সম্পর্কে জানতে পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটের এই লিংকে ভিজিট করুন।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইইউ কেউই এবার আর ৫ জানুয়ারির মত কলঙ্কিত নির্বাচন দেখতে চায় না। ইউরোপীয় ইউনিয়নও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচন একতরফা হলে তারা নির্বাচনের সময় কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবেনা৷ তারা সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়৷ এমন প্রেক্ষাপটে দেশের মিডিয়াকে ব্যবহার করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নামে এমন ভুয়া নিউজ প্রচারে আওয়ামী লীগ সরকারের কারসাজি আছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। তথ্যসূত্র: বিডিফ্যাক্টচেক।