দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজপথে নেমে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকরা। সোমবার (১৫ অক্টোবর) জাতীয় সম্পাদক পরিষদের ব্যানারে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকরা প্রথমবারের মতো মানববন্ধন করেন।
কেন এই আন্দোলন?
বিতর্কিত ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে দেশের সংবাদমাধ্যমকে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রাখার অপচেষ্টার কৌশল হিসেবেই দেখছেন দেশের সব সাংবাদিকরা। এ বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিকরা এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করছেন।
সম্পাদক পরিষদ জানায়, শুরু থেকেই সম্পাদক পরিষদ এ আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল, যেগুলো স্বাধীন সাংবাদিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
পরিষদ জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শেষ মুহূর্তে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাতে সংবাদপত্রের কার্যালয় ও সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর দফতরে প্রবেশ করা, তল্লাশি চালানো, বন্ধ করে দেয়া, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক জব্দ করা, এমনকি পরোয়ানা ছাড়াই সাংবাদিকদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা আরও বেড়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের বক্তব্য
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আয়োজিত সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, এ আইনের কারণে বিশ্বের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের মান নিচে নেমে আসবে।
সোমবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে ডেইলি স্টার সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘তিনি বলেন, বর্তমান আইনটি শুধু সাইবার জগৎ নয়, স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার আইন।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি একটি কালো আইন। এ আইনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠ চূড়ান্তভাবে রোধ করা হল।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার যা খুশি তাই করছে। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তারা গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে চায়। এর পরিণতি ভালো হবে না।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় ঐক্য জরুরি। এটা কোনো দলের নয়। এটা দেশের আপামর জনগণের ঐক্য।
প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইন সাংবাদিকতার পেশাকে পুলিশের নজরদারিতে ঠেলে দেবে যা হবে সাংবাদিকদের জন্য চরম অপমানজনক। সাংবাদিকদের কম্পিউটার ইত্যাদি জব্দ করে নিয়ে যেতে পারবে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে যে জঘন্য ব্যাপারটি ঘটবে তা হল, সাংবাদিকতানির্ভর করবে পুলিশের খেয়ালখুশির ওপর এবং গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় কর্তৃত্ব অকার্যকর হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে গণতন্ত্র থাকে না। বর্তমানে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ একটি অসভ্য আইন। এর চাইতে খারাপ কোনো আইন আর হতে পারে না। বাংলাদেশকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র করতে হলে গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ মানে ফ্যাসিজম। এটাই এখন বাংলাদেশ চলছে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঔপনিবেশিক সময়ের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় নতুন করে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী। সাংবাদিক বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য বড় ধরনের হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হবে এ আইনটির ফলে।
যেভাবে পাস হলো ডিজিটাল আইন
প্রসঙ্গত, গত সোমবার রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলটি আইনে পরিণত করা হয়। জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি, উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস করা হয়।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিলটি পরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠায় সংসদ। সাংবাদিকদের তিনটি সংগঠন সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বিলটি নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। যে ধারাগুলো নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি ছিল, তার কয়েকটিতে কিছু জায়গায় ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা, সাজার মেয়াদ কমানো এবং শব্দ ও ভাষাগত কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে মাত্র।
আইনটি পাসের আগে বিরোধী দলের কয়েকজন সদস্যও এর বেশকিছু ধারা নিয়ে আপত্তি তোলেন। তবে সেসব আপত্তি কণ্ঠ ভোটে নাকচ হয় সংসদে। ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ১১ জন ও স্বতন্ত্র একজন সংসদ সদস্য বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই ও আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রস্তাব দেন। তবে এর মধ্যে তিনজন সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। আর জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন।
সূত্র: যুগান্তর