অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশে একটি সরকারের মেয়াদ ৫ বছর। যখনই যেই সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা প্রথম দুই বছর বলেন, আমরা বিগত দুর্নীতিবাজ সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছি। তাদের রেখে যাওয়া অব্যবস্থাপনা আর জঞ্জাল সরাতে আরো এক বছর গেছে। কাজের পরিকল্পনা করতে আরো এক বছর। হাতে থাকে মাত্র এক বছর। এই এক বছরে আর কি কাজ করবো।
এরকম একটি বয়ান দিয়ে তারা এতগুলো বছর পার করে দিলেন। যখনই নাগরিক কোন সমস্যার কথা তাদের সামনে তুলে ধরা হয়, তারা উপরোক্ত সব অযুহাত দিয়ে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করতেন আর বলতেন, সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে আরো এসব সমস্যার সমাধান করা যেতো।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে ক্ষমতায় আছে একটানা দুই মেয়াদ অর্থাৎ ১০ বছর। এত ক্ষমতা আর আধিপত্য নিয়ে আর কোন সরকারকে বিগত সময়ে ক্ষমতায় দেখা যায়নি। তাছাড়া এতটা নিশ্চিন্তেও অতীতে কোন সরকার দেশ চালাতে পারেনি। দেশে কার্যত কোন আন্দোলন সংগ্রাম নেই। হরতাল, অবরোধ নেই। বিরোধী দলগুলো নানা সংকটে জর্জরিত হয়ে কার্যকর কোন ভুমিকা রাখতে পারছেনা। দেশ এক কথায় সরকারের পূর্ন নিয়ন্ত্রণে।
অথচ এরকম একটি ক্ষমতাধর সরকার, এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরও জনগনের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে কোন ভুমিকা রাখতে পারলোনা। সারা দেশের কথা যদি বাদও দেই, রাজধানীর বাসিন্দাদের কয়েক যুগ ধরে চলে আসা সমস্যাগুলোরও কোন সমাধান তারা করতে পারেনি। যেমন ধরা যাক,
- রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় আগেও গ্যাস থাকতোনা, এখনো নেই। বিভিন্ন সময়ে গ্যাসের লাইনে কাজ করার কথা বলা হয়েছে, বড় বড় পাইপ বসানোর কথা এসেছে। কিন্তু গ্যাসের সংকট আগের মতই আছে। এই সরকার এতদিনেও তেমন কিছুই করতে পারেনি।
- নগরীর বিশাল এলাকা জুড়ে পানি সংকট। যেসব এলাকায় পানি আছে, তারা পানিতে দুর্গন্ধ পাচ্ছেন। পানির সরবরাহ কম। ভুগর্ভস্থ স্তর নীচে নেমে গেছে কিংবা পানির পাম্পে সমস্যা অথবা লোডশেডিং এর কথা বলে অতীত সরকারগুলো দায় এড়িয়েছে। বর্তমান সরকারও সমস্যার কোন সমাধান করতে পারেনি।
- সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিল পাওনা পড়ে আছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। বৃহস্পতিবার সংসদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন শুধু বিদ্যুতের বিলই বকেয়া আছে পনেরশ কোটি টাকা। আওয়ামী সরকার এই বকেয়া আদায়ে কোন উদ্যেগ নেয়নি। এই বিশাল লোকসানকে পোষানোর জন্য পরবর্তীতে হয়তো বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগনকেই শাস্তি দেবে সরকার।
- তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও বাংলাদেশে কমেনি। একবার কমানোর পর বলা হয়েছিল পরের মাসে আবারও হ্রাস করা হবে। আজ অবধি সেই পরের মাসের দেখা মেলেনি।
- বর্ষায় অতীতেও ঢাকার বিভিন্ন সড়ক নদীতে পরিনত হতো, এখনো হচ্ছে। পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নত হয়নি ১০ বছরে।
- রাস্তায় খোড়াখুড়িতে কোন ব্যবস্থাপনা আনা যায়নি। একই রাস্তা একবার ওয়াসা, আরেকবার তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ আরেকবার বিদ্যুতের কাজে খোড়াখুড়ি হচ্ছে সারা বছর। আগে বহুবার সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার সমন্বয়ের কথা বলা হতো। আওয়ামী লীগ ১০ বছরেও সেই সমন্বয় করতে পারেনি।
- ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় কার্যত কোন শৃংখলাই প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
- বাজারমূল্যের উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। অন্য সব সরকারের মত এই সরকারও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে আছে।
- প্রাইমারী শিক্ষক, এবতেদায়ী শিক্ষক কিংবা গার্মেন্টস শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের ন্যায্য দাবীকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কোন সমাধান তো করেইনি, বরং বিষয়গুলো নিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার নাটকে লিপ্ত হয়েছে।
- প্রতি বছর হজ্বে কিছু মানুষ প্রতারণার শিকার হতো, এই ১০ বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
- ঈদের সময় সড়ক, রেলপথে বা নৌ পথে আগেও বিশৃঙ্খলা হতো, যাত্রীদের ভোগান্তি হতো, মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটারের জ্যাম হতো, এখনো হয়। সরকার কার্যত যাত্রীদেরকে স্বস্তিদায়ক ঈদ যাত্রা নিশ্চিত করতে পারেনি।
- ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও শহরকে গতিশীল ও যানজট মুক্ত করতে অতীতের সব সরকারের মতই ১০ বছর মেয়াদী এই সরকারও ব্যর্থ হয়েছে।
- ছাত্রছাত্রীদের বিতর্কিত বই পাঠদান, কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে এই সরকারও নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছে। ছাত্রছাত্রীদেরকে গিনিপিগ বানিয়ে এই সব পদ্ধতির প্রয়োগে মেধাবীরা সঠিক মুল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশ্নফাঁস এই সরকারের আমলে একটি শিল্পের রূপ ধারণ করেছে। কোনভাবেই একে রোধ করা যাচ্ছেনা।
- জনশক্তি রপ্তানীতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সংযুক্ত আরব আমীরাতের মত একটি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উম্মুক্ত করতে পারেনি সরকার। উপরন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পরিবারসহ থাকা কঠিন হয়ে যাওয়ার পরও সরকার সৌদি সরকারের সাথে দুতিয়ালী করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশের শ্রমিকদেরকে বাজেভাবে হয়রানি করার পরও সরকার সেই হয়রানি বন্ধে কোন কুটনৈতিক উদ্যেগ নিতে পারেনি। কুটনৈতিকখাতে এই ব্যর্থতা দীর্ঘমেয়াদী এই সরকারেরও পিছু ছাড়েনি।
- আগের সরকারগুলোর মতই এ সরকারও বিমানসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বাড়াতে পারেনি। মানুষ আগেও বিমানবন্দর বা রেলস্টেশনে গেলে হয়রানির শিকার হতো, এখনো হচ্ছে।
- পর্যটনখাতে মানুষের আগ্রহ বাড়লেও সরকার একই হারে টুরিস্ট স্পটগুলোকে উন্নত ও সেবার মান বাড়াতে পারেনি।
এই তালিকা হয়তো আরো বড় করা যায়। কিন্তু মোটের উপর সত্য কথা হলো এই যে, আমরা যে কোন কলা কৌশলেই হোক ধারাবাহিক সরকার পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা যেই অন্ধকারে ছিলাম সেখানেই আছি। হতাশা ছাড়া এই সরকার মানুষকে আর কিছু দিতে পারেনি। শিক্ষিত মানুষেরাও এখন আস্থা হারিয়ে ফেলছেন, দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। দেশকে সেবা দেয়ার আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলছেন।
সর্বশেষ এই সরকার কয়লা চুরি বা চুনা পাথর চুরির যে ঐতিহ্য চালু করেছে, সেটাও অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। ৪৩ দিন বন্ধ থাকার পর বড় পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু হয়েছে গত শুক্রবার। অথচ তার উৎপাদনও বেশ কম। আর কয়লার অভাবে বাকি দুটি ইউনিটও চালু করা যাচ্ছেনা। কয়লার প্রাচুর্যতা নিয়ে যেখানে আমাদের গর্ব ছিল, সেখানে বড় পুকুরিয়ার মত একটা কয়লা খনিকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছে এই সরকার। দুদক খনির এমডিসহ বেশ কয়েকজনকে আইওয়াশ জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, কয়লা লোপাটের ঘটনা সরকারের যোগসাজশেই হয়েছে। এই ধরনের দুর্নীতি নাগরিকদের দুর্ভোগ আরো বাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই, পাশাপাশি সরকার ও দেশের প্রতি মানুষকে অনাগ্রহী করে তুলবে, যা কারো জন্যই সুখকর হবেনা।