অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সপ্তাহখানেক ধরে রাষ্ট্রকে ভীষণ ধাক্কা দিয়েছে স্কুল কলেজের ছাত্ররা। তারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এদেশে পরিবহন সেক্টর যে কতটা দুর্নীতিগ্রস্থ। মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ-র্যাব এবং শাসনকাজের সঙ্গে যুক্ত সবাই বলে চলেছেন যে বাচ্চারা তাঁদেরকে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছে এবং সরকার তাদের দাবিমতো ব্যবস্থা নেবে। সরকারের কথায় শিক্ষার্থীরা কেন আস্থা রাখতে পারছে না, সেদিকটিতে নজর না দিয়ে এখন এই আন্দোলনে রাজনীতি খোঁজা শুরু হয়েছে।
গোয়েন্দারা এখন ব্যস্ত বিরোধী দলের রাজনীতিক ও সমালোচকদের টেলিফোনে আড়িপাতায়। কর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দেওয়ার ওই টেলিফোনকে ষড়যন্ত্র হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ভর করেছে। আন্দোলনকে তারা সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
এতকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দটি হলো ‘গুজব’। ‘গুজব’ তত্ত্বটি সরকার বাহাদুর হাজির করেছে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়। সেখানে আমরা নানা ঘটনা দেখেছি। দেখেছি ছাত্রলীগের নেত্রী এশা একটি আন্দোলনকারী একটি মেয়ের রগ কেটে দিতে। তড়িঘড়ি করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি তার পদ বাতিল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব বাতিল করে। অথচ ২৪ ঘন্টা না যেতেই এই ঘটনা গুজব হয়ে গেলো। সে আবার পদ ফিরে পেলো। ফিরে পেলো ছাত্রত্ব। শাস্তি তো তার হলোই না বরং যাদের সে নির্যাতন করেছে এমন ২৪ জনকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজনকে হলের সিট ছাড়তে হয়েছে।
সেই থেকে গুজব হয়ে গেলো রাজনৈতিক শব্দে। এই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও সরকারি চাপে বা সেলফ সেন্সরড হয়ে মিডিয়া পুরোপুরি ব্ল্যাক আউট। আজকাল মানুষের মিডিয়ার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ লাইভ করে সব জানতে ও জানাতে পারে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে ঢাকা পরিণত হয়েছে গুজবের শহরে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশই গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। গুজব বন্ধের উপায় হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে থাকা মূলধারার গণমাধ্যমকে আরও স্বাধীনতা দেওয়ার বদলে সরকার নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছে। এমনকি, সরকারের কট্টর সমর্থক টিভি চ্যানেলও বাদ যায়নি। জনমনে ‘আতঙ্ক এবং জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা’ তৈরির অভিযোগ করা হয়েছে দুটি চ্যানেলের বিরুদ্ধে। সরাসরি সম্প্রচারে উত্তেজনা ছড়ানো সম্প্রচার নীতিমালার পরিপন্থী বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে অন্যদের।
মিডিয়ায় খবর না পেলে গুজব যে আরও বেড়ে যাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সরকার যখন কী কী ঘটেনি বলে ঘোষণা দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কী কী ঘটেছে। গুজবের কারণে সরকার ২৪ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেটে, বিশেষত মোবাইল নেটওয়ার্কে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে অ্যানালগ যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বিস্মিত মানুষের মনে যদি প্রশ্ন জাগে, সরকার কিছু গোপন করতে চায় কি না, তাহলে কি সেটা অন্যায় হবে?
বাংলাদেশের নামকরা ফটো সাংবাদিক শহিদুল আলম আল জাজিরাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছে। সেই ৪ মিনিটের সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই অপরাধে অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে এরেস্ট করা হয় এবং পিটিয়ে রক্তাক্ত করে সরকার। এছাড়াও বহু সাংবাদিককে রাস্তায় পিটিয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ। সাংবাদিকদের ওপর হামলা তো তথ্যপ্রবাহ বন্ধের চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।
দেশের সকল মানুষ দেখেছে হেলমেট পরা একদল যুবক ছোট ছোট ছাত্রদের উপর হামলা চালিয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি করেছে। পিটিয়েছে। পুলিশ সেই হেলেমেট বাহিনীকে প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা উল্টো সহায়তা করেছে। এর মধ্যে আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ পলক জানিয়েছে ঝিগাতলায় কিছু হয়নি, কেউ হতাহত হয়নি সব গুজব। অথচ হসপিটালগুলি ভরে গিয়েছে আহত ছাত্রদের ঢলে। কারা সেই হেলমেট বাহিনী? কেন পুলিশ তাদের সহায়তা করেছে? কেন পলক মিথ্যা কথা বলছে? সরকার সবকিছুকে গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ তারা বুঝতেই পারছে না সরকার নিজেই গুজবে পরিণত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বহুবার তার কথা রাখতে পারেননি। বিশেষত সদ্য গত হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে তার পল্টি নেয়া জাতিকে হতাশ ও সরকারের প্রতি অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তিনি এর থেকে কতটা শিক্ষা নিয়েছেন তা বুঝা গেলো ছাত্রদের এই আন্দোলনে। তিনি শুরুতেই বলেছেন দাবী সব মেনে নিবেন। অথচ গতকাল চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া পরিবহন আইনে ছাত্রদের মূল দাবীকেই উপেক্ষা করা হয়েছে। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সবাইকে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেছে। কিন্তু এই ফিরে যাওয়ার আহ্বানে যে কষ্ট ছিল তা তিনি লুকাতে পারেন নি। সংবাদ সম্মেলনে সবার সামনেই কেঁদে ফেললেন। কান্নার কারণে তিনি শেষ কথাগুলো পর্যন্ত বলতে পারলেন না। যে দেশের মূল ব্যাক্তির উপরই বিশ্বাস রাখা যায় না সেদেশে মানুষের কোন ভরসা নেই। মন্ত্রীরা, সরকারি কর্মকর্তারা সমানে মিথ্যা কথা আর লুটপাটে ব্যস্ত।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে কয়েক দিন ধরে সরকার এমন সব বক্তব্যযুক্ত পোস্টার ছড়িয়েছে যেগুলোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হেয় করা, তারা যাতে আর মানুষের সহানুভূতি না পায় সেই চেষ্টা করা। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরত যাওয়ার কথা বোঝানোর দায়িত্ব ছাত্রলীগকে দেওয়া যে ভিন্ন বার্তা দেয়, সেটা তো আর কারও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কোটা সংস্কারের আন্দোলন এবং ডাকসু নির্বাচনের আন্দোলনে ছাত্রলীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে ভূমিকার কথা সবাই এত দ্রুত ভুলে যাবে কীভাবে?
শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরানোর সহজ পথ ছিল পরিবহন খাতে সব নষ্টের মূলে যাঁরা, তাঁদের মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দেওয়া। সড়কের নিরাপত্তার জন্য গত জুনে প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়নে গত ছয় সপ্তাহে একটি পদক্ষেপও নিতে না পারার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে তো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। ফিটনেসবিহীন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলো বন্ধের অভিযান শুরু করতেও কি দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়? বেআইনিভাবে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া কেউ যানবাহন বন্ধ রাখলে তার রুট পারমিট বাতিলের মতো ব্যবস্থা নেওয়া তো বিদ্যমান আইনে কঠিন কিছু নয়।
দুজন সহপাঠীর হত্যার বিচার সময়সাপেক্ষ এবং আইন তৈরির প্রক্রিয়াও রাতারাতি যে শেষ হবে না, সেটা শিক্ষার্থীরা যে বোঝে না, তা নয়। কিন্তু যেসব ব্যবস্থা নিলে আস্থার ঘাটতি এখনই দূর হতে পারে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকার যে দলীয় সংকীর্ণতায় ভুগছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তো নিলোই না বরং ছাত্রদের উপর চড়াও হয়েছে। সরকার ব্যস্ত কে টেলিফোনে কী বলেছে সেটা নিয়ে? কে উস্কানী দিয়েছে? কে গুজব রটিয়েছে? কে সাক্ষাৎকার দিয়েছে? ফেসবুক লাইভ করার অপরাধে অভিনেত্রী নওশাবাকে রিমান্ডে নিয়েছে অথচ যারা দা, ছুরি, চাপাতি, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে তাদের একজনকেও এরেস্ট করলো না।
এই সরকারকে বিশ্বাস করার কোন পথ আর অবশিষ্ট রাখেনি সরকার। সবকিছুকে গুজব বলে উড়িয়ে দিতে গিয়ে নিজেরাই গুজবে পরিণত হয়েছে।