চন্দন নন্দী
জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক বিকালে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে আমার মোবাইলে। কলকারী ইংরেজিতে জানালেন তার নাম আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী। কুশল বিনিময়ের পর চৌধুরী খোলামেলা জানালেন যে তিনি তিন সদস্যের একটি দলের সাথে ভারত এসেছেন। দলটি ভারতে মূলত ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। রাজনীতিকদের বাইরে তারা ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কের কিছু ব্যক্তির সাথেও দেখা করেছেন।
বিএনপি স্পষ্টতই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রয়েছে। দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া ঢাকা কারাগারে আটক। আটক রয়েছেন দলের আরও কয়েকজন সিনিয়র নেতা। এ অবস্থায় বিএনপি ভেবেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের ক্ষমতাসীনদের সখ্যতা থাকলেও তারাও আগামী নির্বাচনের আগে নয়াদিল্লীর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে কোন এক সময় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। অবশ্য ‘যদি নির্বাচন হয়’ – চৌধুরী যেমনটা বলেছেন। বিএনপি খুব একটা আশাবাদী নয় যে নির্বাচন আহ্বানের আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার কথা ভাববেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখানে অনিশ্চয়তার একটা দিক রয়ে গেছে এমনকি বিস্ময়ও হয়তো অপেক্ষা করছে।
“অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ প্রচারণার সময়েই হেরে যাবে”, মনে করেন চৌধুরী। যে দলের শীর্ষ নেতারা কারাগারে, যে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা রয়েছে বিশৃঙ্খলার মধ্যে, সে দলের প্রতিনিধির কাছ থেকে আসা এই বক্তব্যটি যথেষ্ট ভারী। এ বিষয়ে পরে কথা হবে।
চৌধুরীর টিমের সাথে আরও ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ূন কবির। তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল বিএনপি’কে এমনভাব তুলে ধরা যে দলটি বাংলাদেশের রাজনীতির অনাকাঙ্ক্ষিত ইসলামপন্থী ও মৌলবাদী উপাদানগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। অন্যভাবে বললে এটা ছিল ভারত-বিরোধী জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) এবং তাদের জঙ্গি সহযোগী দল খেলাফত আন্দোলনের প্রতি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। হাসিনার আমলে এই দুই দলই কঠিন আঘাত পেয়েছে।
এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার আগ্রহ দেখাননি চৌধুরী। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে ধারণা পাওয়া গেছে যে, খালেদার ছেলে তারেক রহমানের অনুমোদিত বিএনপি’র এই প্রতিনিধিরা ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি যখনই বাংলাদেশে নির্বাচন হোক না কেন, সেটা যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে, সে ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের সমর্থন আশা করেছেন তারা। স্বাভাবিক যুক্তিতে মনে হবে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সাথে দেন-দরবারই বিজেপির জন্য বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের হবে কারণ ভারতের সাথে বন্ধুত্বের তেমন রেকর্ড নেই বিএনপি ও জামায়াতের, তা নয়াদিল্লীর ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক আদর্শ যা-ই হোক না কেন। তবে সেখানে একটা কিন্তু রয়ে গেছে।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যুরোক্র্যাসির সূত্রগুলো এসএএম-কে জানিয়েছে, হাসিনার দিল্লী সফরের সময় বা সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরের সময় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও হাসিনার মধ্য প্রকাশ্যে যত সুসম্পর্কই দেখা যাক না কেন, “সমস্ত পথই খোলা রাখা হবে”। সূত্র এসএএমকে জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ খুব ভালো করেই জানেন যে বাংলাদেশে তাদের অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে নির্বাচনে স্বাচ্ছন্দ্যে পার হয়ে যাওয়াটা অত সহজ হবে না এবং তাদের অবশ্যই ভারতের সাহায্য লাগবে। হাসিনার দল অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিবাদে বিপর্যস্ত। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িত দলের বিভিন্ন অংশকে (দলে এরকম অংশ রয়েছে অনেক) সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, দলবিরোধী কর্মকাণ্ড শক্ত হাতে দমন করা হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তার কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগিরা এ ব্যাপারে অবগত রয়েছেন যে, টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে একটা জোরালো ‘এন্টি-ইনকমবেন্সি ফ্যাক্টর’ তৈরি হয়েছে। এই সময়কালে যে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং এগুলোর কারণে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলোর চেয়েও এই ফ্যাক্টর ভোটারদের উপর বেশি প্রভাব ফেলবে। যদিও বিষয়টি পুর্ণ মাত্রায় প্রকাশ হয়নি, কিন্তু যখনই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর দমন চালানো হয়েছে, তখনই জনতার ক্ষোভের বহি:প্রকাশ দেখা গেছে।
এই অবস্থায় প্রশ্ন হলো ভারত কি শুধু এক পক্ষের উপর বাজি ধরবে? ক্ষমতাসীন ভারত সরকার প্রকাশ্যে স্বীকার করছে যে আওয়ামী লীগ তাদের প্রাকৃতিক মিত্র। কিন্তু বিএনপির সাথেও বৈঠক করেছে তারা। এটা কোন নতুন বিষয় নয়। আশির দশকে এবং তার পরেও ভারতের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিএনপি নেতৃবৃন্দের সাথে গোপন সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এটা স্মরণ করা যেতে পারে যে, অটল বিহারী বাজেপেয়ীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স সরকারের সময় তৎকালীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর ব্রজেশ মিশ্র খালেদা জিয়া ও অন্যান্য বিএনপি নেতাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য ঢাকা সফর করেছিলেন। প্রয়োজনে যেকোন পক্ষের সাথেই যে তার সরকার যোগাযোগ রাখতে পারে, সেটা তিনি পরিস্কার করে দিয়েছিলেন।
থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর যে বিশ্লেষকদের সাথে তিন বিএনপি নেতা সাক্ষাত করেছেন তারা সাউথ এশিয়ান মনিটর (এসএএম)-কে জানিয়েছেন যে, ভারতকে নির্বাচনী পাঞ্চিং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার না করার যে আশা, সে ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা যাচাইয়ের জন্য প্রতিনিধি দলের কথা ‘ধৈর্যের সাথে’ শোনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই যে নয়াদিল্লী সরকারের প্রভাবকে কাজে লাগাতে চাইবে এ ব্যাপারে বিজেপি সচেতন। তাই বিজেপি সরকার এমনকি খালেদা জিয়ার দলকেও সরকারে দেখতে চাইতে পারে। কথাটা যতই হাস্যকর শোনাক না কেন এর মাধ্যমে বিজেপি’র অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান একসাথেই। বাংলাদেশে বিএনপি সরকার আসলে সীমান্তবর্তী রাজ্যটিতে বিজেপির জন্য সেটা সুবিধাজনক হতে পারে বিশেষ করে যেখানে বিজেপি সম্প্রতি তার ট্রেডমার্ক- ‘হিন্দুবাদী রাজনীতির সূচনা করেছে। বিএনপি আগে যেভাবে ভারত কার্ড খেলেছে তা বিবেচনায় নিলে বিএনপি’র পূর্বের ভারত বিরোধী অবস্থান বিজেপির ভোট প্রাপ্তির জন্য লাভজনক হতে পারে।
চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলকে যে সব থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান আতিথেয়তা দিয়েছিল, তাদের মধ্যে একটি হলো অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশান। এর প্রথিতযথা ফেলো মনোজ যোশি এসএএম-কে বলেন, বিএনপির অবস্থানের মধ্যে ‘একটি সত্যিকারের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে’, কারণ ‘দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গেছে’ বিশেষ করে এখন যদি তাদেরকে রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হয়।
পোড় খাওয়া সাংবাদিক থেকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বনে যাওয়া যোশি বলেন, “বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনেক বিপদের মধ্যে রয়েছে”, বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে সেই বেদনা ফুটে উঠেছে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যখন অব্যাহতভাবে বিরোধীদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় “জামায়াত আর কোন নির্বাচনী ইস্যু নয়” বলে স্বীকার করেন বিএনপি নেতারা। যোশি বলেন, প্রতিনিধিরা বিএনপির রাজনীতি সম্পর্ক ভারতের ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বিকল্প অর্থনৈতিক এজেন্ডা তাদের আদৌ রয়েছে কি না, এ নিয়ে তারা কিছুই বলেননি।
বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এই প্রতিযোগিতামূলক ভারত তোষণের মধ্যে আওয়ামী লীগই সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে। তবে বিএনপি দ্রুত পদক্ষেপ না দিলেও তারা এখন ভাবছে যে, নয়াদিল্লী ও তাদের কথিত অবস্থান বদলের কারণে ভারতের উদারতা তাদের পক্ষে থাকবে। ভারতের গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন, “বিএনপিকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিতে হবে যে তারা ভারত-বিদ্বেষী অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এছাড়া তাদেরকে বাংলাদেশের জন্য বিকল্প, টেকসই আর্থ-সামাজিক মডেলও তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে যে সময়টাতে বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-নেপাল-ভারত) এবং বিসমটেকের (বে অব বেঙ্গল ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশান) মতো উপ-আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের দিক থেকে বিএনপির জন্য দুয়ার পুরোপুরি বন্ধ করতে চান না। এ রকম রিপোর্টও শোনা গেছে যে, বিএনপি নেতৃত্বের একটি অংশ বিগত কয়েক মাস ধরে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্তত একটি দেশে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। এই বৈঠকগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং এগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে নয়াদিল্লী তাদের সবগুলো পথই খোলা রাখতে চায় এবং কোন বিশেষ দলের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়তে চায় না, বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে তাদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। বিএনপির প্রতিনিধি দলটি এই আশ্বাস নিয়ে ঢাকায় ফিরেছে যে আবার ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে বৈঠক হবে।
সাউথ এশিয়ান মনিটরের সাথে ফোনে কথা বলার সময় চৌধুরী বলেন, “নির্বাচন ঠিকমতোই হবে”। কিন্তু এ নির্বাচনের “ধরন ও বৈশিষ্ট্য” নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি, যেটা তার ভাষায় আওয়ামী লীগের ‘নির্বাচন প্রকল্প’। তবে, তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, শেখ হাসিনার সরকার যখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রায় নিয়মিত ‘গুম’ করছে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে ও তাদেরকে গ্রেফতার করছে, এ অবস্থায় ‘এক পক্ষের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করাটা’ ভারতের স্বার্থের জন্য অনুকূল হবে না।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর