বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে। আর প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রায় যদি পাল্টে না যায়, তাহলে হয়তো খালেদা জিয়াকে ছাড়াই শেষ মুহূর্তে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।
বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত রয়েছে ভারত। এতে হয়তো মনে হবে যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ভারতের সমর্থন জারি রয়েছে।
ভারত কিছুটা কৌশলে ২০১৪ সালের একপক্ষীয় সাধারণ নির্বাচনকে সমর্থন জানিয়েছিল, যেটা বয়কট করেছিল বিএনপি। অর্ধেকের বেশি আসনে (৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি) ভোটগ্রহণ ছাড়াই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল সে সময়। মাত্র ২২ শতাংশ ভোট পড়লেও ভারতের সমর্থনের কারণে বৈধতা পায় ওই নির্বাচন।
শেখ হাসিনার অধীনে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে, যেটা বিএনপি থাকলে হতো না। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রাখার জন্য হয়তো আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের আইনী কৌশলের সাথেই তাল মিলিয়ে চলবে ভারত। ভারত যদি কোন নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তিকে সমর্থন দেয়, তাহলে আবারও তাদের যন্ত্রণার পুণরাবৃত্তি হতে পারে, বিশেষ করে নেপাল ও মালদ্বীপে যেটা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের সময়কাল ১৯৯১ সাল এবং মামলাটা করাই হয়েছে ১৮ বছর পরে। নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে রায় দেয়াটা নিশ্চিত করার জন্য মামলায় তাড়াহুড়া করা হয়েছে, যাতে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা যায়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হ্ত্যাকাণ্ডের পর তার নামে একটি এতিমখানা চালুর জন্য ১৯৯১ সালে কুয়েতের আমীর ১,২৫৫,০০০ ডলারের (৪.৫ কোটি টাকা) অনুদান দিয়েছিলেন। “প্রধানমন্ত্রীর এতিমখানা তহবিলের” নামে অনুদানটি এসেছিল, যদিও এ ধরনের কোন তহবিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তখন ছিল না। ১৯৯৩ সালে, কুয়েতের দেয়া অনুদান (সুদসহ) সমান দুই ভাগে ভাগ করা হয় এবং নতুন গঠিত দুটি প্রতিষ্ঠান বগুড়ার “জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট” এবং বাগেরহাটের “জিয়া মেমোরিয়াল অরফানেস ট্রাস্টের” মধ্যে ২.৩৩ কোটি টাকা করে দিয়ে দেয়া হয়। প্রথমটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান এবং দ্বিতীয়টির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এই দুটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার কোন ভূমিকা রয়েছে, এ ধরনের কোন কাগজপত্র কেউ দেখাতে পারেনি। মামলার কারণে বিভিন্ন সময়ে বরাদ্দ অনুদানের অর্থ ব্যবহার করা হয়নি, যার বর্তমান পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি টাকায়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়া, তার ছেলে তারেক এবং আরও চারজনকে দোষি সাব্যস্ত করা হয়েছে, যেখানে টাকার পরিমাণ মাত্র ২.৩৩ কোটি। মামলার আইনগত বিষয়গুলো হয়তো বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞরা দেখবেন, কিন্তু এই মামলার রাজনৈতিক গুরুত্ব সন্দেহাতীত।
২০০৬-২০০৮ সময়কালে সামরিক সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের সময় এই মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনা- দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকেই রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা নিয়ে কাজ করছিল তখনকার সরকার। দুজনার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির মামলা দেয়া হয়েছিল- খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চারটি এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছিল মর্মে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রয়ে যায়। এখন আরও নতুন মামলা যুক্ত হয়ে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। তখন থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আট লাখ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলাগুলোর রাজনৈতিক চারিত্র খুবই পরিস্কার।
বেগম জিয়াকে দোষি সাব্যস্ত করার বেশ কিছু উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য উসকে দেয়া, দলটিকে ভাগ করা অথবা যেভাবেই হোক এটা নিশ্চিত করা যাতে খালেদা জিয়াকে ছাড়াই নির্বাচনে যেতে হয় বিএনপিকে।
এটা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিএনপি নির্বাচন ব্য়কট করবে না। তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণার মধ্য দিয়ে, বিএনপি যখন সম্ভাব্য খারাপতম পরিস্থিতির জন্য তৈরি হচ্ছে, সে সময় বেগম জিয়ার জামিন নাকচ করা হয়েছে।
এখন অন্তত মনে হতে পারে যে, শেখ হাসিনা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই উপরে। তার শাসনামলে দেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতিও হয়েছে – অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের উপরে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, পণ্যের কেনাকাটা এবং আয়ের মাত্রা বেড়েছে এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
এর পরও বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকায় (বিগত প্রধান বিচারপতিকে দেশ থেকে একরকম তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে), সরকার পরিচালনার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী- বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নের (র্যাব) উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা, মিডিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের দমননীতি, নাগরিক সমাজ ও বাক স্বাধীনতার উপর হুমকি এবং প্রতিপক্ষের লোকজনকে গুম করার কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় অসন্তোষ রয়েছে। অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন হলে, তাই অনিশ্চিত একটা ফলাফল আসবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপারে ভারত অতিমাত্রায় খুশি এবং তারা ক্ষমতায় ফিরে আসলে ভারত খুশিই হবে। বিএনপি সম্পর্কে ভারতের ধারণার উৎস হলো দলটির আগের ইতিহাস, যখন তারা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল এবং দলটির উপর এবং তাদের প্রদান মিত্র দল জামায়াতে ইসলামীর উপর পাকিস্তানের কথিত প্রভাব। এই জোটের আদর্শকেও নিজেদের জন্য উদ্বেগের মনে করে ভারত যদিও বিএনপি এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছে যে, এটা কেবল একটা নির্বাচনী জোট।
কিছু বাংলাদেশী তাই বিশ্বাস করে যে, যদি একটা দুর্বল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে ভারত বরং স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করবে। শেখ হাসিনা সে ক্ষেত্রে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসবে।
এই ধরনের অনুমান হয়তো ভুল হবে। এই সম্ভাবনা কম যে ভারত আবারও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিকৃতির জন্য ভূমিকা রাখবে। ২০১৪ সালের মতো আওয়ামী লীগের মেকানিজমে সমর্থন দেয়াটা হবে অন্যায্য, যেটার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনা তৈরি হবে এবং আরও ভারতবিদ্বেষী হয়ে উঠবে বাংলাদেশের মানুষ। ভারতের সে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা উচিত। যদি তাদের পরামর্শ চাওয়া হয়, ভারতের সে ক্ষেত্রে শুধু সে ধরনের কাজকেই সমর্থন দেয়া উচিত যেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সততাকে সংহত করবে এবং অবাধ ও মুক্তভাবে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটাবে- সেটা যাদের পক্ষেই হোক না কেন।
সূত্র: দ্য এশিয়ান এজ, ভাষান্তর: সাউথ এশিয়ান মনিটর