মুসাফির রাফি
প্রশ্নপত্র ফাঁসের মওসুম চলছে। ফেসবুক ওপেন করলেই প্রশ্ন পাওয়া যায়। পত্রিকা খুললেই এই সংক্রান্ত রিপোর্টও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের এই করুন পরিনতির প্রতিচ্ছবি বেশী স্পষ্ট হয় যখন কোন পাবলিক এক্সাম চলে। যেমন এখন এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেদিনই পরীক্ষা থাকছে, সেদিন প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষা আর প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে জড়িয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের এই আমলে। জাতি কোন পাপের কারনে এই শাস্তি পাচ্ছে- কে জানে।
এত বড় একটি ঘটনা এই প্রশ্নপত্র ফাঁস, অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই সংক্রান্ত ভুমিকা খুবই রহস্যময়। সন্দেহটা জাগছে আসলে সে কারনেই।
দুনিয়ার যত সমস্যা সব আওয়ামী লীগ সমাধান করতে পারে। একটা আস্ত বড় রাজনৈতিক দলকে গিলে ফেলার দু:সাহস দেখাতে পারে। প্রতিপক্ষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তাকে আঘাত করে থামিয়ে দিতে পারে, খড়ের স্তুপের ভেতর থেকে সূঁচ বের করতে পারে, অজ পাড়াগাঁয়ে জঙ্গী আস্তানা খুঁজে বের করে দেশজুড়ে জঙ্গী নির্মুল অভিযান করতে পারে। অথচ এত সক্ষম এই দলটি ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরের উপর নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করার পরও কেন তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বন্ধ করতে পারবেনা? কেন এর সাথে জড়িতদেরকে ধরে শায়েস্তা করতে পারবেনা? আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলকে দমন করতে যতটা সিরিয়াস, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে কি ততটা সিরিয়াস? আদৌ কি তারা এই অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে চায়?
ছাত্রলীগের সভাপতি সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দাবী করেছেন তাদের আমলে নাকি প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনাই ঘটেনি। তার কথা শুনে অনুষ্ঠানটির সঞ্চালকও (যিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রচন্ডভাবে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা) যেন বেকুব হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন সে দৃশ্যমান একটি সত্যকে অস্বীকার করলো?
এবার আসা যাক, বাম আন্দোলন থেকে সরে আসা তথাকথিত নীতিবান ও সৎ লোক আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব প্রসঙ্গে। এর আগে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে পরীক্ষার হলে এত সাংবাদিক-ক্যামেরা নিয়ে আর যাবেন না, তাতে নাকি পরীক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট হয়। অথচ এবারও প্রায় ২৫টি টিভি ক্যামেরা নিয়ে তিনি হল পরিদর্শনে গেলেন। নিজে আদেশ দিয়ে নিজেই তা অমান্য করার মত সততা অবশ্য নাহিদ সাহেবের মত সৎ মানুষের কাছ থেকেই আশা করা যায়।
এই নীতিবান(!) মানুষটিকে যখন সাংবাদিকেরা এই প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে কিংবা যখন তাকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার্থীদের মাঝে বিতরন করা প্রশ্নটির সাদৃশ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখনও তিনি নির্লজ্জের মত পুরো বিষয়টিকে অস্বীকার করেন। অথচ পরিস্কারভাবেই দেখা যাচ্ছিল যে, মুল প্রশ্নপত্র আর ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র আসলে একই।
কেন আওয়ামী লীগের নেতারা এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ইস্যুটি নিয়ে এতটা লুকোচুরি খেলছেন। কেন তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন, এই বিষয়টি আসলে তদন্ত সাপেক্ষ। তবে বিজ্ঞজনেরা বলছেন, স্বদিচ্ছার অভাবেই তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের নোংরা খেলাটি বন্ধ করছেন না। আর এই স্বদিচ্ছাটি জাগ্রত না হওয়ার একমাত্র কারন আর্থিক স্বার্থ।
একেকটি প্রশ্ন ফাঁস করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং তাদের সহযোগী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা আসলে বেশ বড় অংকের টাকার ব্যবসা করেন। অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সব অবৈধ এবং বিশাল লেনদেনের একটি বিরাট অংশ আসলে সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টারের পকেটেও যায়। নীচ থেকে উপর পর্যন্ত সবাই সুবিধা পাওয়ায় কেউই আসলে এই কৃত্রিম সমস্যাটির সমাধানও করতে চায়না। আর আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের দালালির পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়েছে। যেই তারা টের পেয়েছে, এর সাথে সরকারী দলের লোকজন জড়িত, তারাও এখন হাত গুটিয়ে বসে আছে।
প্রকৃত বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এসে আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস নামক একটি নতুন বানিজ্য চালু করেছে। এই ব্যবসায় পুঁজি লাগেনা। নৈতিকতা বিসর্জন দিলেই হয়। বিনা পুঁজিতে বেশ কিছু অসৎ লোক এই পরীক্ষার সিজনগুলোতে এসে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারিনা, কতটা অর্থলিপ্সু ও অনৈতিক মানসিকতার হলে আসলে একটা দল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কোমর ভেঙ্গে দিতে পারে।
পিয়াঁজ, চাল নিয়ে তো গত ৬ মাসে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেই ফেললেন, অন্তত শিক্ষা ব্যবস্থাকে রেহাই দেন। আপনাদের ছেলে মেয়েরা এই দেশে না পড়লেও সাধারন মানুষগুলোর সন্তানেরা তো পড়ে, দয়া করে পরীক্ষার প্রশ্নকে পন্য বানিয়ে ব্যবসা করা বন্ধ করুন। ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতাসীন দল বা দলের নেতারা বিশাল পরিমান টাকা বানিয়েছে, এই ব্যবসাটা বন্ধ করলে হয়তো তাদের খুব একটা ক্ষতি হবেনা।
সাধারন মানুষের ইস্যু নিয়ে গেম খেলা বন্ধ করুন। নইলে কঠিন পরিণতি অপেক্ষা করছে।