মিরাজ খন্দকার
সম্প্রতি একটি সুখবর দেশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু মানুষ এই নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলেনি। এটা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়নি। মানুষের মধ্যে কাজ করছে চাপা আতঙ্ক। সাধারণ মানুষ অচলবস্থা শেষে সুদিনের যে প্রত্যাশা করেছিল তাতে ভাটা পড়েছে। সবচেয়ে বেশী প্রভাব কাজ করেছে বিরোধী দলীয় কর্মীদের মধ্যে। তারা নির্বাচনী আমেজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ক্ষমতার স্বপ্নে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তাদের সেই স্বপ্নে হঠাৎ ছন্দপতন।
গত হপ্তায় টানা তৃতীয়বার আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আশায় সজিব ওয়াজেদ জয় বলেন, “একটা সুখবর জানাতে আমি এসেছি। আগামী নির্বাচন নিয়ে আমি জরিপ করেছি। দলকে জানাতে যে, আমার জরিপের রেজাল্ট এত ভালো আসছে যে, আজকে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে বোঝা যাবে আগের চেয়েও বেশি ভোট পাবে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের চেয়েও বিপুল, ল্যান্ড স্লাইড পাবে আওয়ামী লীগ।
সজিব ওয়াজেদ জয় আরো বলেছেন, এটা সায়েন্টিফিক্যালি জরিপ করে আমরা পেয়েছি। এখানে আওয়ামী লীগের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ কথাটা জানাতে আমি এসেছি।
একটা জরিপ যে কেউ করতেই পারে। আর সে জরিপের ফলাফল নিজেদের মত করে সাজানোও কঠিন কিছু নয়। কিন্তু জরিপ যখন সজিব ওয়াজেদ দেয় তখন মানুষ সেখানে অন্য ইঙ্গিত পায়। কারণ অন্য সবার জরিপের মত নয় সজিব ওয়াজেদের জরিপ। এখানে কোন তথ্য উপাত্ত থাকে না। থাকে না কোন স্ট্যাটিসটিক্সের সূত্র। থাকে না কোন পার্সেন্টেজ ব্যাপার স্যাপার। এখানে কেবল থাকে একটাই তথ্য। আওয়ামীলীগ জিতে যাবে।
শুধু আওয়ামীলীগ জিতে যাবে বললেও হয়তো এতটা আতঙ্কিত হত না সাধারণ মানুষ। কিন্তু সজিব ওয়াজেদ জয় যখন বলেছেন ২০০৮ এর মত বা তার চেয়ে বেশী ভালো হবে ফলাফল। এতেই যত ভয়, যত আশঙ্কা। সবাই অনুমান করতে পারছে কী হতে পারে ২০১৮ সালের নির্বাচনে? কারণ তারা জানে কী হয়েছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে?
দেশের মানুষ জানে আওয়ামীলীগের কী অবস্থা? আওয়ামী নেতারাও তাদের মাঠের অবস্থা ভালো করেই জানেন। শুধু জনগণ নয়, আওয়ামীলীগ নেতারাও জানেন নির্বাচন যদি নির্বাচনের মত হয়, তাহলে আওয়ামীলীগ জিতার কোন সম্ভাবনাই নাই। সজিব ওয়াজেদ জয়ের এমন সুখবর স্বস্তির বাতাস ছড়িয়েছে আওয়ামী মহলে। ওরা জয়ের জরিপ রিপোর্ট বা তথ্য বিশ্বাস করেছে এমনটা নয়, তারা কনফার্ম হয়েছে জয় নিশ্চয়ই এমন ব্যবস্থা করেছে যাতে হারতে না হয়।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন পায়। এতে মোট ভোটের ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ভোট পায় দলটি, যার সংখ্যা তিন কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯টি।নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি আসন জিতলেও ভোট পেয়েছিল দুই কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০১টি; যা মোট প্রদত্ত ভোটের ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
২০০৮ সালের নির্বাচনটা আসলে কেমন ছিল এটা নিয়ে একটা মিথ চালু ছিল বাংলাদেশে আর সেটা হল জেনারেল মঈন দায়মুক্তিসহ নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আর নির্বাচনটা ছিল কেবলই দেখানো। ফলাফল আগেই সেট করা ছিল। এই মিথ আর মিথের পর্যায়ে নেই। কারণ নাটের গুরু নিজেই তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন আত্মজীবনীতে। নাটের গুরু কিন্তু এখানে জেনারেল মঈন নন। নাটের গুরু প্রনব মুখার্জি।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে, শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তার দায়িত্ব নিই এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তার সেনাবাহিনী প্রধানের পদ বহাল থাকার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করি।
২০০৮ সালের নির্বাচন ভারতের কতটা তত্ত্বাবধানে ছিল তা সহজেই অনুমেয়। জয়ের এমন জরিপ ইঙ্গিত দেয় তারা এমনি একটি ইলেকশনের দিকেই আগাচ্ছে। জয়কে যখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল,এটি কোন প্রতিষ্ঠানের জরিপ? উত্তরে তিনি বলেন, “জরিপটা আমরা প্রত্যেক বছরই করি। আমাদের একটা কোম্পানি আছে, সেটা থেকেই করি। এটা আমার বিষয়, এটা নিয়ে আমি স্টাডি করেছি, কাজ করেছি। তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে, আমার জরিপ হচ্ছে মোস্ট অ্যাকিউরেট জরিপ।”
জরিপের কথা যা তা, আওয়ামীলীগ যে ক্ষমতায় পুনরায় আসছে, এটা যে অ্যাকিউরেট কথা এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের জনগণ এই ইঙ্গিতই পেয়েছে জয়ের বক্তব্য থেকে। এর মানে এই যে নির্বাচনের নামে যত কথা হচ্ছে তা কেবলই বাকওয়াজ। এখানেই জনগণের ভয়। আওয়ামীলীগ নিশ্চয়ই ভারতের সাথে নতুন কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আবার ক্ষমতায় থাকার পাঁয়তারা করছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকার এই পলিসি আওয়ামীলীগের পুরাতন স্বভাব। ক্ষমতায় থাকার শর্তে যে কোন আপোষে তারা রাজি।
জয়ের বক্তব্যে আরো যে বিষয় উঠে এসেছে সেটা হল প্রোপ্যাগান্ডা। বিরোধী দলের কুৎসা রটনার জন্য তারা এক মিথ্যাকে বার বার বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যেমন তারেক জিয়া একজন দুর্নীতিবাজ এই কথাটাকে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের সব মানুষ মোটামুটি মনে করে তারেক দুর্নীতিবাজ এমনকি যারা তারেকের সমর্থক তারাও মনে করে একটু আধটু দুর্নীতি তারেক করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত কথা হল তারেকের বিরুদ্ধে করা বহু দুর্নীতির মামলার একটিও প্রমাণিত নয়। তাহলে তাকে কীভাবে দুর্নীতিবাজ বলা যেতে পারে?
সম্প্রতি বলা হচ্ছে খালেদার জিয়ার অবৈধ সম্পত্তি নাকি সৌদী আরবে পাওয়া গিয়েছে এমন খবর প্রচার করেছে একাত্তর টিভি আর ইকবাল সোবহানের বাংলাদেশ অবজার্ভার। তারা সেখানে কানাডার একটি টেলিভিশন এবং গ্লোবাল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের বরাত দিয়ে নিউজ করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল কানাডায় দ্যা ন্যাশনাল নামে কোন টিভিই নেই। আর গ্লোবাল ইন্টেলিজেন্সেও এই ব্যাপারে কোন তথ্য নেই। অথচ এমন একটি জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা হাসিনা ওয়াজেদ নিয়মিতই বলে যাচ্ছেন।
আওয়ামীলীগ কীভাবে মিথ্যা ছড়ায়? এটা জানার জন্য খুব বেশী গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটা আঞ্চলিক পত্রিকা ভুয়া ফক্স নিউজের বরাত দিয়ে রিপোর্ট করেছে খালেদা জিয়া সেরা দুর্নীতিবাজের মধ্যে তৃতীয়। বেশ সাড়া পড়ে আওয়ামী মহলে। চট্টগ্রামের বিএনপি মামলা করে এমন মিথ্যা খবর ছাপানোতে। ঐ পত্রিকা ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সেটা এমুখে ওমুখে প্রতিধ্বনি হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।
জয় আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে এমনই প্রচারের জন্য বলেছেন তিনি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণার কথা বলতে গিয়ে বলেন, “দেখেন এখানেই তো প্রমাণ হচ্ছে তারা কীভাবে মিথ্যা কথা বলে। তারেক রহমান এবং কোকোর বিরুদ্ধে এফবিআই এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। তারা দুর্নীতি করেছে, ঘুষ নিয়েছে, তাদের টাকা পাওয়া গেছে। এফবিআই এসে বাংলাদেশে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। সেখানে মির্জা ফখরুল কীভাবে বলেন তাদের বিশ্বের কোথাও কোনো অ্যাকাউন্ট নেই? এই খবর তো আমাদের কাছ থেকে আসে নাই। এটা আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে এসেছে, যে তাদের সৌদিতে ১২ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “তাদের টাকা তো আগেও ধরা পড়েছে, এফবিআই পেয়েছে। এবারও ধরা পড়েছে। এটা তো কিছুই না, নিশ্চয়ই আরও টাকা তাদের আছে, আরও অনেক জায়গায়, যেটা আমরা জানি না।”
জয়ের সুখবর আওয়ামীলীগের জন্য। জয় অবশ্য সেই কথাই বলেছেন। জয়ের সুখবর বাংলাদেশের মানুষদের জন্য আতঙ্কের। কারণ জয় এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন আগামীতে নির্বাচন হলেও সেটা হবে ২০০৮ সাল মার্কা নির্বাচন। যে নির্বাচনে মানুষের চিন্তা প্রতিফলিত হবে না। প্রতিফলিত হবে প্রনব মুখার্জির মত অন্য কারো চিন্তা। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জয়ের এই ধরণের জরিপ নতুন কিছু নয়। ১৪ সালের আগেও তিনি এমন উদ্ভট জরিপের ফলাফল ঘোষণা করেছেন। তখন তিনি বলেছেন ‘আমার কাছে তথ্য আছে’। তখন বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হলেও পরবর্তিতে দেখা যায় জয়ের প্রেডিকশন সঠিক। তাতেই মানুষের ভয়। বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে আসছে নির্বাচন ২০১৪ সাল বা ২০০৮ সালের নির্বাচনের মতই পাতানো হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post