ঘটনাটি গত শনিবারের (১৮ নভেম্বর)। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল নাগরিক সমাবেশ। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যেই ঘটনাটি ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনের এলাকায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) একজন ক্যামেরাম্যান মিছিলের চিত্র ধারণ করছিলেন। ভিডিও ধারণের ফাঁকে তাকে এক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করতে দেখা যায়। আলাপ চলাকালে ওই নেতা পকেট থেকে টাকা বের করেন। আর চোখের পলকেই সেই টাকা চলে যায় ক্যামেরাম্যানের হাতে।
টাকা নেওয়ার এই ঘটনাটি দেখে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক বিটিভির ক্যামেরাম্যানকে অনুসরণ করেন। এরপর তিনি মোবাইলে ওই ক্যামেরাম্যানের এ ধরনের কমপক্ষে পাঁচটি ঘটনার দৃশ্য ভিডিও করেন। তার তিনটি ভিডিও এখন বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আছে।
এর মধ্যে একটি ভিডিওতে টাকা লেনদেনের ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ওই ভিডিও ধরে অনুসন্ধান চালায় বাংলা ট্রিবিউন। তাতে বিটিভির ক্যামেরাম্যানের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি হলেন বিটিভির সহকারী চিত্রগ্রাহক ফরিদ আহমেদ। আর যে নেতার কাছ থেকে তাকে টাকা নিতে দেখা গেছে তার পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি হলেন সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ জাহিদ (এসএম জাহিদ)। তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
ভিডিওতে দেখা যায়, একেকটি খণ্ড মিছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে আসছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে ফরিদ ভিডিও করছেন, কখনও তাদের বক্তব্যও ধারণ করছেন। এরপর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলছেন। তারপরই নেতা পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিচ্ছেন। আর টাকা নিয়ে তিনি দ্রুত সরে যাচ্ছেন।
সেই প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেদিন বেলা ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত টিএসসি ও আশেপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালনের সময় ওই ক্যামেরাপারসনকে অন্তত ৪০ জনের কাছ থেকে টাকা নিতে দেখেছি।’
টাকা নেওয়ার পদ্ধতি বর্ণনায় করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে ছোট ছোট মিছিল এলেই মিছিলের সামনে গিয়ে ফুটেজ নিয়ে, কখনও কখনও বুম (মাইক্রোফোন) ধরে বক্তব্য নেন তিনি। এরপর নেতাদের বলেন, আমাদের আরও ক্যামেরা আছে। কথা বলার ছলে ওই নেতার পাশে দাঁড়ালে তার হাতে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেইদিন বিটিভিতে দেখানোর কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ওই ক্যামেরাম্যান আনুমানিক এক লাখ টাকা নিয়েছেন। তাকে টাকা দেওয়ার তালিকায় সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কমিশনার, নারী নেতা, যুবলীগ নেতা, আওয়ামী লীগ এর নানা পর্যায়ের নেতারা ছিলেন। ’
ওই সাংবাদিক বলেন, ‘দেখে মনে হয়েছে প্রতিজনের কাছ থেকে তিনি দুই-পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন।’
ক্যামেরাম্যান ফরিদকে ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেইদিন আমার সোহরাওয়ার্দীতে ডিউটি ছিল। আমার সঙ্গে তো রিপোর্টারও ছিল। তবে ছবি দেখলে বুঝতে পারতাম কোন ঘটনার কথা বলছেন।’
মিছিলের ভিডিও করার পর নেতার পাশে গিয়ে টাকা নিতে দেখা গেছে আপনাকে-এমন বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফরিদ বলেন,‘ওহ লম্বা করে ওই ব্যক্তি? উনি কমিশনার, আমার পরিচিত। প্রধানমন্ত্রীর বাসার ওইদিকে কোন এলাকার যেন কমিশনার।’ কমিশনারের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘লম্বা করে, ছোট ছোট ছোট দাড়ি আছে। মোহম্মদপুরের কমিশনার উনি। কিন্তু নাম ভুলে গেছি। উনার কাছে কিছু টাকা পেতাম সেটা দিয়েছে।’
কত টাকা পেতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সামান্য, ৫০০ টাকা।’
এর কিছুক্ষণ পরই তিনি এই প্রতিবেদককে আবার কল করেন এবং বলেন,‘টাকা দেওয়া ওই ব্যক্তি যুবলীগের নেতা জাহিদ। তিনি আমাদেরকে দুপুরে খাওয়ার জন্য দেড় হাজার টাকা দেন।’
এভাবে টাকা নেওয়া নৈতিক কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেন আমি এরকম করি না। আমি এই টাইপের না। নেতা মানুষ উনি, টাকা দিয়েছেন। আবার তখন ক্ষুধাও লেগেছিল। কারণ আমরা তো বেলা ১১টার দিকে সেখানে গেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি লজ্জিত, আমি কিন্তু এগুলো করি না। ছোট বোন হিসেবে এগুলো লেইখেন না। অন্য সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করে নিয়েন। উনি আমাকে ডেকে দিয়েছেন কিনা সেটা জানতে পারবেন। আসলেও আমি লজ্জিত।’ ওই ফুটেজ গেছে কিনা প্রশ্নে তিনি জানান, ‘অনএয়ার (সম্প্রচার) হয়েছে।’
বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপ-মহাপরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি জানালে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো দেখিনি, টাকা নিয়ে থাকলে কে দিলো কী জন্য দিলো আমি তো জানি না। লিখিত অভিযোগ করলে কর্তৃপক্ষ দেখবে। কেবল ওর কথা বলছি না, সব জায়গায় একই অবস্থা। এগুলো রোধ করা দরকার, কিন্তু করবেন কিভাবে? এর চেয়ে বড় দুর্নীতি করছে না? করছে তো।’
এই যে অভিযোগ শুনলেন এ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেবেন কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো।’
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক এস এম হারুন অর রশীদ বিষয়টি জেনেছেন এবং ভিডিওটি খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ভিডিওটি এখনও আমি দেখিনি। অভিযোগের সত্যতা মিললে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ধরনের বকশিশ নেওয়া কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।’
এদিকে, টাকা দেওয়ার ঘটনার বিষয়ে জানতে যুবলীগ নেতা এস এম জাহিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তার এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তিনি রবিবার কলকাতা গেছেন।
মানিকগঞ্জের ঘিওর আসন থেকে এবার জাতীয় নির্বাচনের এসএম জাহিদ প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে।
ঘটনার দিন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম জাহিদের সঙ্গে থাকা সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জিয়াউল হক জিয়া জানান, ‘বিটিভির ক্যামেরাম্যান আমাদের মিছিলের ভিডিও করেছেন। তবে জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন কিনা দেখিনি।’
https://www.youtube.com/watch?v=zc_2grL7jW4&feature=youtu.be
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post