জুনায়েদ আব্বাসী
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই চরম বিতর্ক চলে আসছে। আর এই বিতর্কের সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতাদের দৃষ্টিতে তারাই একমাত্র স্বাধীনতার দাবিদার। বাদ বাকী সবাই স্বাধীনতা বিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে খুব একটা বিতর্ক ছিল না। ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মিলেই স্বৈরাচার এরশাদের পতন আন্দোলন করেছিল। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সহযোগিতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। ওই সময় আওয়ামী লীগও সরকার গঠন করতে সহযোগিতার জন্য জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে লোক পাঠিয়েছিল। সরকার গঠনে আ.লীগকে জামায়াত সমর্থন না দিলেও তখন জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ মুখ খুলেনি।
১৯৯৫ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। বিএনপির পতনের পর ৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পার্টির সহযোগিতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ৯৯ সালের নভেম্বরে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার পরই জনগণের সহমর্মিতার জন্য আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। তখন থেকে তারা জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে আখ্যা দিতে থাকে।
২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসার পরই আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা বিরোধী এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বলে জনগণের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করতে থাকে। এর আগে শুধু জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী বললেও পরে এর সঙ্গে বিএনপিকেও যুক্ত করে।
বিশেষ করে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতার ঘোষক ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করতে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের ভাষায়-জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেন নি। আর করলেও তিনি ছিলেন পাকিস্তানের চর। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানকে আওয়ামী লীগ শুধু অস্বীকারই করেনি, আদালতের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সর্বশেষ আওয়মাী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান নামে তিনি কারো নাম শুনেন নি। তিনি জিয়াউর রহমানকে তখন চিনতেন না।
তোফায়েল আহমেদের এ বক্তব্য নিয়ে এখন সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
এদিকে, আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদেরকে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার বলে দাবি করলেও ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালানোর পর পরই আওয়ামী লীগের সব সিনিয়র নেতা পালিয়ে ভারতে চলে যান। দেশের সাধারণ মানুষ দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন ও রক্ত দিলেও আওয়ামী লীগ নেতারা কলকাতার বিলাস বহুল হোটেল ও নাইট ক্লাবে বসে বসে আনন্দ ফুর্তি করতেন। বাঙ্গালী যুবকরা ভারতের যেসব ট্রেনিং শিবিরে প্রশিক্ষণ নিতেন, আওয়ামী লীগ নেতারা ভুলেও সেখানে যেতেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় নবম সেক্টরের কমান্ডার এম এ জলিল তার লেখা ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বইয়ে লিখেছেন, আমি ফোর্ট উইলিয়ামের অন্ধকূপ থেকে মুক্তি পেয়ে নবগঠিত সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। দেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণকে হিংস্রদানবের মুখে ঠেলে দিয়ে কলকাতার বালিগঞ্জের আবাসিক এলাকার একটি দুই তলা বাড়িতে বসে প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রী সভা সহকারে নিরাপদে বসে তাস খেলছিলেন দেখে আমি সেই মুহূর্তে কেবল বিস্মিতই হইনি, মনে মনে বলছিলাম ধরণী দ্বিধা হও।
এছাড়া কলতাকার পার্ক স্ট্রীটের অভিজাত নাইট ক্লাবগুলোতে বসে বসে আওয়ামী লীগ নেতারা আড্ডায় মেতে উঠতো। ট্রেনিং শিবিরে বাঙ্গালী যুবকেরা কী হালতে আছেন একটু খোঁজও নিতেন না আওয়ামী লীগ নেতারা।
তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য শুনে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন রাতের আঁধারে পালিয়ে ভারত গিয়েছিল কেন? এটাই কি তাদের মুক্তিযুদ্ধ? কলকাতার হোটেলে বসে ওরা কার সাথে যুদ্ধ করেছিল? এদেশের নারী-পুরুষ যখন তাদের জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছিল, তখন কলকাতার বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে কোন দলের নেতারা আরাম আয়েশ করেছিল? সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে কারা ভোগবিলাসে লিপ্ত ছিল?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জহির রায়হান বেঁচে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অনেকখানি জানা যেত। এমনকি আওয়ামী নেতাদের কু-কীর্তির কিছু দৃশ্যও দেখার সুযোগ হতো। তিনি একজন সাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতাদের বহু অপকর্মের সচিত্র প্রামাণ্য দলিল তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তারা জানত জহির রায়হান বেঁচে থাকলে কোন একদিন তাদের সকল কু কর্ম ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এজন্যই ওরা চিরতরে বিদায় করে দিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সচিত্র ইতিহাস জহির রায়হানকে।
এছাড়া, আগরতলা মামলার তিন নাম্বার আসামি স্টুয়ার্ড মুজিব বেঁচে থাকলেও আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘৭১র সেই চেহারা কিছুটা প্রকাশিত হত। তিনিও জানতেন অনেক কিছু। আওয়ামী লীগের নেতারা ভারতে বসে কী অপকর্ম করছিল সবই দেখেছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব। এ দেখাই ছিল তার অপরাধ। তাকেও বরণ করে নিতে হয়েছে জহির রায়হানের পরিণতি।
Discussion about this post