ড. আবদুল লতিফ মাসুম
আগেকার দিনে কাব্য, কবিতা কিংবা পুঁথি শুরু হতো প্রশস্তি দিয়ে। প্রথমে সৃষ্টিকর্তার পরে শিক্ষক, দীক্ষক বা গুরুর প্রশংসা স্থান পেত। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন-ইসি যে সংলাপের সূচনা করেছে তা আগেকার মতো প্রশংসা-প্রশস্তি দিয়ে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের জনচরিত্র অনুযায়ী একের প্রশংসা অন্যের সহ্য হয় না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সবার জন্য প্রশস্তি গেয়ে একটু বিপদেই পড়েছেন। এখন তিনি এই বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রশংসার প্রতিযোগিতা করছেন। তাতে ক্ষমতাসীন দল তুষ্ট হলো কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চাচ্ছেন। তার হয়তো ভয় বেশি কচলাতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মতো আবার কোনো অঘটন ঘটে। প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এমনটির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলায় অনাবশ্যকভাবে তার কিছু পর্যবেক্ষণ যুক্ত করে যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন, তার জের থেকে দেশ এখনো মুক্ত হয়নি। তার রেশ শেষ হতে না হতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিছু অবাস্তব ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলে আবার বিতর্কের ঝড় কেন সৃষ্টি করতে চাইছেন তা আমার কাছে এক রহস্য’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ অক্টোবর ২০১৭)।
ঘটনার শুরু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসির সংলাপ থেকে। সংলাপের শুরুতে সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘জিয়াউর রহমান এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে তার নেতৃত্বে আবারো সরকার গঠিত হয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন।’ এ মন্তব্যের পর আওয়ামী মহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে আস্থায় নেয়ার কৌশল হিসেবে এমন বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন সিইসি। এতে আওয়ামী লীগের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।’
ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই জিয়াকে গণতন্ত্র হত্যাকারী ও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে বিবেচনা করে। উচ্চ আদালতের একাধিক রায়েও এটা এসেছে। এ অবস্থায় সিইসির বক্তব্য আওয়ামী লীগকে কিছুটা বিস্মিত করেছে।’ আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সিইসিকে না ঘাঁটানোর পরামর্শ দিলেও মন্ত্রীরা নীরব থাকেননি। ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘আপনারা রেফারি, আপনাদের কাজ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা। আপনারা সেটাই করুন। আর কথা কম বলেন। একজন কথা বেশি বলেছে, দেখেছেন না কী হয়েছে? কথা বলার জন্য আমরা পলিটিশিয়ানরা আছি।’
অপর দিকে জাসদ নেতা, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের নয়, সামরিকতন্ত্রের প্রবক্তা। সাংবিধানিক পদে বসে কোনো ব্যক্তি ইতিহাস ও রাজনীতি চর্চা করলে পদ বিতর্কিত হয় এবং ব্যক্তির নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়।’ সবচেয়ে মজার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ। তারা সিইসির মন্তব্যের প্রতিবাদে সংলাপের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে এবং ওই মন্তব্যের জন্য সিইসির পদত্যাগ দাবি করে। এতদিন ধরে আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচক জনাব সিদ্দিকীর এই আচরণে রাজনৈতিক মহল কিছুটা বিস্মিত হয়। কেউ কেউ রবীন্দ্রনা থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘রাজা যা বলে, পরিষদ বলে তার শতগুণ।’ অন্য পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করেন, ‘তিনি হয়তোবা তার ভাইয়ের হারানো সিংহাসন উদ্ধার করতে চাহেন।’
যা হোক সিইসি যখন ১৮ অক্টোবর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপে বসেন, তখন তিনি আওয়ামী প্রশস্তি গেয়ে বিএনপি সম্পর্কে তার মন্তব্য ঢেকে দিতে চান। আনুগত্যের প্রমাণ দিতে তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের নির্দেশনা চান। এ সময় তিনি ৯ মিনিটের বক্তব্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে অভিহিত করেন। তিনি আওয়ামী লীগের অতীত ঐতিহ্য, ইতিহাস, সরকার পরিচালনা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জনসহ বিভিন্ন অবদান তুলে ধরেন। দেশের সব অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এসেছে। দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি। পরে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালউদ্দিন আহমেদও ক্ষমতাসীন দলের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করেন, সংলাপে ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ডের প্রশংসায় আওয়ামী নেতাদের আপ্যায়িত করেছে ইসি। সিইসি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আপনাদের অনেকের কাছ থেকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা নেয়ার, দীক্ষা নেয়ার, সাহস নেয়ার, অনুপ্রেরণা পাওয়ার, পথচলার দিকনির্দেশনা নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। দৃশ্যত সিইসির দীর্ঘ প্রশস্তিতে আশ্বস্ত হন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। সংলাপের পরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বিএনপি বিষয়ক মন্তব্যটি এড়িয়ে যান। বোধগম্য হয় যে তিনি সিইসির ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সিইসির এই প্রশংসা প্রতিযোগিতা ছিল একটি অনাহূত ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়। বৈঠকটি নির্বাচনবিষয়ক সুপারিশের জন্য আহূত। আলোচ্য বিষয় এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে এ বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। তবে বিষয়টি যদি এমনতর হয় যে, বিএনপি নেতৃত্বকে খুশি করার জন্য, আস্থায় নেয়ার জন্য তিনি এ কথা বলেছেন- যেমনটি বলেছেন ওবায়দুল কাদের, তাহলে বিষয়টি আরো অন্যায় বলে বিবেচিত হবে। নির্বাচনের বিষয়টি ‘লিপ সার্ভিস’-এ সীমাবদ্ধ নয়। নির্বাচনটি বিশাল ঝুঁকিপূর্ণ এক মহান দায়িত্ব। সেখানে কারো নিরঙ্কুশ প্রশংসা ও নিন্দাবাদের জায়গা নয়। প্রশংসার পরিবর্তে আরো বেশি প্রশংসা করে সিইসি বিষয়টি ঘোলা করে ফেলেছেন। এমনিতেই তিনি আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত লোক এবং আওয়ামী কৌশলেই সিইসি নির্বাচিত হয়েছেন- এমন মন্তব্য বিএনপিসহ সব বিরোধী মহলের। সেখানে ব্যক্তিগত আবেগ, উত্তাপ ও উচ্ছ্বাসের স্থান নেই। সিভিল সোসাইটি সব সময়ই সিইসিকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, কাজটি অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা সিইসির ব্যক্তিগত সাহস, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল। নির্বাচন কমিশন অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিমান- সিইসির এই মন্তব্য যদি সঠিক ধরে নেয়া যায়, তাহলে সেই শক্তির পরীক্ষা তিনি আগামী নির্বাচনে খোলা ময়দানে বাস্তবে প্রায়োগিক অর্থে দেখাবেন বলে নাগরিক সাধারণ বিশ্বাস করতে চায়।
এ তো গেল সরকারি ও বিরোধী দলের প্রশংসার প্রতিযোগিতাবিষয়ক বক্তব্য। এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। নির্বাচন কমিশন ঘর গুছিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করেছে- এটি একটি ইতিবাচক বিষয়। নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝা এবং আস্থায় নেয়া জরুরি ছিল। ইতোমধ্যে তারা ৩৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেছে। ২৪ আগস্ট থেকে সংলাপ শুরু হয়। ১৯ অক্টোবর তা শেষ হয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন সম্পর্কে তাদের মতামত জ্ঞাপন করেছে। যদি এ সব রাজনৈতিক দলের মতামতগুলোর সাধারণ সমীকরণ করা হয় তাহলে কিছু কমন বিষয় বেরিয়ে আসে। বিষয়গুলো হচ্ছে- নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, আস্থা ও বিশ্বাসের পুনরুদ্ধার, নির্বাচনব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা, সব দলের জন্য সমান সুবিধার নিশ্চয়তা প্রদান এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনকে সুষ্ঠু সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য করার বিবিধ প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে পেশ করেছে। এদিক থেকে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত, সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যত নিরপেক্ষ ধরনের- যার প্রশংসা স্বয়ং সিইসিও করেছেন। এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় একটি সমস্যা হচ্ছে কথা ও কাজের মিল না থাকা। আওয়ামী লীগের ১১ দফা প্রস্তাবের নির্যাস খুবই ভালো। যেমন তারা নির্বাচনকালীন সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলার কথা বলেছে, নির্বাচন কর্মীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বলেছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও সতর্কতার কথা বলেছে, গণমাধ্যমকে নির্বাচনের বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বলেছে, নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে কঠোর আইন এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রস্তাব করেছে। যেকোনো ব্যক্তি এসব প্রস্তাবনার প্রশংসা করবেন; কিন্তু বাস্তবে কি তাই?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও পৌরসভাগুলোর নির্বাচন কিসের প্রমাণ দেয়? এ বিষয়ে সবিস্তরে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। পাঠক সাধারণ নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার কথা মনে করলেই বাস্তব চিত্র ফুটে উঠবে। দৃশ্যত এসব ভালো ভালো প্রস্তাবের বাইরে কিছু কৌশলগত প্রস্তাবও রয়েছে- যেগুলো তাদের নির্বাচনী প্রকৌশলের প্রমাণবহ। যেমন- তারা নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে কার্যকর ক্ষমতা দিতে চায় না। তার কারণ কি এই যে, তারা সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না? বাংলাদেশে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও মানুষের এখনো সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। যথার্থভাবেই প্রশ্ন করা যায়, সর্বত্র সেনাবাহিনীর প্রয়োগ হলে নির্বাচনে তাদের উপস্থিতিতে ক্ষতি কি? দ্বিতীয় প্রশ্ন তাদের ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সম্পর্কে। পৃথিবীর সর্বত্র যখন ক্রমেই ইভিএমের কার্যকারিতা অগ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হচ্ছে তখন বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর এবং বেশির ভাগ অশিক্ষিত ভোটারের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ প্রেক্ষিত কতটা যৌক্তিক হবে তা বিবেচ্য বিষয়।
আরেকটি বিরোধীয় বিষয়- নির্বাচনের সীমানা নির্ধারণ। বিএনপির অভিযোগ, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী সহায়ক তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের উপযোগী করে অন্যায়ভাবে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করেছে। সুতরাং এ নির্বাচনে এর সংশোধন প্রয়োজন। অপর দিকে আওয়ামী লীগ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং আসন্ন নির্বাচনের পূর্বে বিরোধ মীমাংসায় সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
অপর দিকে, বিএনপি নির্বাচনী সংলাপে যেসব প্রস্তাবনা ও পরামর্শ দিয়েছে সবগুলোকে নেতিবাচকভাবে দেখছে আওয়ামী লীগ। তারা বলছে, এসব প্রস্তাব অন্যায়, অবাস্তব, অযৌক্তিক এবং নির্বাচন ভণ্ডুলের পাঁয়তারা মাত্র। উল্লেখ্য, বিএনপি সেখানে ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথম ও প্রধান দাবি হচ্ছে, নির্বাচনের ৯০ দিন আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। প্রদত্ত ২০ দফা দাবির অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ : লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকারের সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ এবং ভোট গণনা শেষে প্রিজাইডিং অফিসারের ফলাফল না দিয়ে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ না করা ইত্যাদি।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, উভয় দলের বাস্তব ক্ষেত্রে অবস্থান বিপরীতধর্মী। ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকির কারণে যে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছে, তাদের পক্ষে সহায়ক সরকার মেনে নেয়াটা কতটা সঙ্গত হবে? বাস্তব সত্য এই, ভেতরে ভেতরে সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সুতরাং সহায়ক সরকারের প্রস্তাব মেনে নেয়া অওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য।
নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক সংলাপ শুধুই প্রশংসার প্রতিযোগিতা হতে বাধ্য, যদি না এসব সংলাপের মাধ্যমে অর্থবহ পরিবর্তন ও সংস্কার অনুষ্ঠিত না হয়। নির্বাচন কমিশন ব্যবহারিকভাবে এবং নীতিগতভাবে এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যে, তারা সংলাপে উত্থাপিত প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। তা ছাড়া রাজনৈতিকভাবে এবং আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ক্ষমতাসীনদের যেকোনো পরামর্শ নিতে বাধ্য। দীর্ঘ দিন ধরে নির্বাচন কমিশন সরকারের ‘বি টিম’ হয়ে খেলার কারণে ‘এ টিম’ হওয়ার সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি হারিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন বিগত নির্বাচনগুলোতে যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে- তা থেকে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ একরকম অসম্ভব বলেই মনে হয়।
নির্বাচন কমিশন যদি সত্যি সত্যিই একটি জনগ্রাহ্য নির্বাচন উপহার দিতে চায় তাহলে তাদের সাহসী ভূমিকা নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠী- কোনোটিই গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনগণের সম্মতি। নির্বাচনের মাধ্যমে এই সম্মতি যদি প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়, তাহলেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠত হতে পারে। আর গণতন্ত্র জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল। গণতন্ত্র অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনসহ সব ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের ভূমিকা অনন্য, অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠুক- এখন এটাই আমাদের প্রার্থনা।
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post