তৈমূর আলম খন্দকার
ষোড়শ সংশোধনীকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতিকে (বিচারপতি এস কে সিনহা) জড়িয়ে যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছিল তা আরো ঘনীভূত হলো গত ৩ অক্টোবর তার এক মাসের ছুটি রাষ্ট্রপতির গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ষোড়শ সংশোধনীর রায়টি ঘোষণার পর সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বা আওয়ামী ঘরানার লোকেরা প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে যেসব কথা প্রকাশ্যে বলেছেন; তারপর ‘আদালত অবমাননার’ আইন কার্যকর থাকার কোনো যুক্তি থাকে না।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আওয়ামী ঘরানার বলে মানুষের ধারণা। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অত্যন্ত অনুগত বলে তিনি বারবার তার বক্তব্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এরপরও বিচারপতি সিনহাকে এভাবে অপমান-অপদস্থ করার অর্থ কী? রাষ্ট্রপতি নিজেই এ প্রক্রিয়াকে প্রশ্রয় দিলেন কিভাবে? অং সান সু চি নির্মমভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কূটকৌশল করে বিচারপতি সিনহাকে ভিন্নপন্থায় সরিয়ে দিয়ে শুধু বিচার বিভাগ নয়, বরং প্রধানমন্ত্রী নিজের ওপর কালিমা লেপন করে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
বিভিন্ন নেট, লোকমুখে প্রচার-প্রপাগান্ডা, আইনজীবীদের বক্তব্য সব মিলিয়ে এটাই ধারণা হয়- বিচারপতি সিনহা পদত্যাগ করেননি; বরং জোর করে তাকে পদত্যাগপত্র নামের কাগজে স্বাক্ষর করিয়েছে বলে কোর্ট প্রাঙ্গণে জোরালো জনশ্রুতি রয়েছে। প্রধান বিচারপতির যদি এ অবস্থা হয়, তবে বাকি ১৬ কোটি সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিরাপত্তা কোথায়? বিষয়টি নিরপেক্ষ ও নিখুঁত তদন্তসাপেক্ষ।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টকশোতে অংশ নিতে একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যাই। সেখানে একটি প্রথিতযশা দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক নেতার মুখে শুনলাম, ‘শেষ পর্যন্ত সরকার সব কিছুর ওপরই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো; বিচার বিভাগ বাকি ছিল এটার ওপরও সরকার এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে।’ এ মর্মে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘প্রধান বিচারপতি ১০ দিনের ছুটিতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন, বিচারপতি সিনহা অবসরে যাওয়ার আগে এ ছুটি নন-স্পট বর্ধিত হতেই থাকবে।’ এ বিষয়টি ইঙ্গিত করে জাতীয় দৈনিকে ইতঃপূর্বে আমার লেখা উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে এত মরিয়া হয়ে উঠল কেন? এটি অধিক সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার বিষয়।
উল্লেখ্য, আর কেউ জানুক বা না জানুক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার জানে, তারা অনির্বাচিত। বিগত কয়েকটি সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট ইতঃপূর্বে অবৈধ বলেছেন। ১৫৩ জন বিনা ভোট ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচিত হওয়ায় যে তামাশা দেখিয়েছে, তাদের কেউ ‘অনির্বাচিত’ বা অবৈধ ঘোষণা হওয়ায় একটা আতঙ্ক সব সময়ই সরকারের মধ্যে বিরাজমান। যেকোনো যুক্তিতেই বলুক না কেন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে এ সরকার নির্বাচিত হয়নি, বরং ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচন যে একটি হঠকারী তামাশার নির্বাচন এটা সবাই উপলব্ধি করেন, সরকার ও সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা স্বীকার করুক বা না করুক (!)। সাধারণ মানুষ মনে করে, এ ছুটি স্বেচ্ছায় নয়, বরং জোরজবরদস্তিমূলক। ১৫৩ জন অনির্বাচিত সংসদ সদস্যের পদ বাঁচাতেই এ নাটকীয়তা, যা সাংবিধানিক অবস্থানকে আরো জটিল করে তুলবে।
প্রধান বিচারপতির (এস কে সিনহা) ছুটি নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে আরো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যা জনগণ বিশ্বাস করতে পারছে না। আইনমন্ত্রী ৩ অক্টোবর বলেছেন, বিচারপতি সিনহার ক্যান্সার হয়েছে, যা দেশবাসী কোনো দিন ইতঃপূর্বে শোনেনি। মি. সিনহার সাথে আইন পেশা এবং বিচারক হিসেবে দীর্ঘ দিনের সম্পৃক্ততার মধ্যে কোনো দিন শুনিনি যে, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। যা হোক, রোগ কাউকে বলে-কয়ে আসে না সত্য হলেও আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের ‘সত্যতার’ মধ্যে ক্যান্সার ধরা পড়ে। জনগণের সামনে ক্যান্সারের দালিলিক প্রমাণ আইনমন্ত্রীকেই দিতে হবে, কারণ তিনি সত্য বা সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য শপথে আবদ্ধ। এ ক্যান্সার কি বিচারপতির দেহে না আইনমন্ত্রীর মনে তা খতিয়ে দেখতে হবে। ভিন্নপথে প্রধান বিচারপতিকে নির্বাসনে দেয়ায় সরকার যে প্রক্রিয়া সৃষ্টি করল তা গোটা বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিসহ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ওপর সরকারের যে নগ্ন নিয়ন্ত্রণ তা-ও স্পষ্ট হয়ে গেল।
স্বৈরশাসকদের প্রধান টার্গেট থাকে বিচার বিভাগ। সে কারণে এ বিভাগের টুঁটি চেপে ধরা স্বৈরাচারের সহজাত প্রবৃত্তি। অনেক সুন্দর কথা বলে ১/১১-এর সেনাসমর্থিত স্বৈরশাসক ক্ষমতায় বসেই বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। জাতীয় সংসদে ক্যাঙ্গারু কোর্ট স্থাপনের মাধ্যমে কোর্টকে (ক্যাঙ্গারু কোর্ট) ব্যবহার করেছে এবং ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলো আদিষ্ট হয়ে নির্ধারিত ব্যক্তিদের সাজা দিয়েছেন। ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলোর নির্বিচারের প্রতি উচ্চ আদালতে তখন কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। দু-একজন বিচারপতি ছাড়া সবাই কাক্সিক্ষত রায় দানে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, বিচারপতিদের বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য। কিন্তু তখন বিচারপতিরা পদত্যাগ না করার জন্যই ‘ইয়েস উদ্দিন’ নামে পরিচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের দাওয়াত গ্রহণ করেননি।
বিচারপতি সিনহা দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, সংসদের ৩০০ এমপিও যদি সংবিধান সংশোধন করে এবং তা যদি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী হয়, তবুও তা বাতিল করে দেবো। তিনি আরো বলেছিলেন, জীবন দিয়ে হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করব, কোনো ধরনের আপস করব না। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ‘লগোর’ পরিবর্তে ‘মূর্তি’ বসানোর মতো বিতর্কিত কিছু কাজ ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষাসহ আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করার জন্য মি. সিনহা দৃশ্যমান ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু ছুটির দরখাস্তে যদি মি. সিনহা স্বাক্ষর দিয়ে থাকেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই আপস করেছেন। কোন পরিস্থিতিতে তিনি ছুটির দরখাস্তে স্বাক্ষর করেছেন তা বিবেচ্য নয়, বরং প্রাণের বিনিময়ে হলেও তিনি বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষা করবেন এ ঘোষণা দেয়ার পরও কোনো কারণেই এ ছুটির দরখাস্তে স্বাক্ষর করে তার সম্মান তিনি অক্ষুন্ন রাখতে পারেননি। তবে তিনি স্বাক্ষর দিয়েছেন কি না এ সম্পর্কে জনমতে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যা অনেক সন্দেহপ্রবণ। জনগণের সন্দেহ দূর করার দায়িত্ব সরকারের। প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার দায়িত্ব সরকারের। কারণ শপথে আবদ্ধ একজন কেবিনেট মন্ত্রী কোনো কারণেই নিজের খেয়ালের বশীভূত হয়ে এমন কথা বলতে পারেন না, যাতে কোনো ‘সত্যতা’ নেই। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তবে বুঝতে হবে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় মন্ত্রীরাও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নন।
কিছু কিছু ঘটনায় মনে হয়, বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই; অথচ রাষ্ট্রীয় কলকাঠি নাড়ায় তাদের অনেক ক্ষমতা রয়েছে। এ ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু ‘ক্ষমতা’র জন্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে থাকলেও অনুচ্ছেদ-৪৮(৩) মোতাবেক তিনি ‘ট্রাফিক জ্যামে’ আটকে রয়েছেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ভাষায়- কবর জিয়ারত ও মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত থাকা ছাড়া রাষ্ট্রপতির অন্য কোনো কাজ নেই; এমনকি জাতীয় সংসদে তিনি কী ভাষণ দেবেন তা-ও মন্ত্রিপরিষদ তথা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে দিতে হয়। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে সরকারের ভূমিকায় দেশে বা আন্তর্জাতিকভাবে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তার দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি এড়াতে পারবেন না; যদিও বিষয়টি উপলব্ধি করার অবকাশও সাংবিধানিকভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘অনির্বাচিত সরকার’ একটি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সঙ্কট। এ সঙ্কট নিরসন করার দায়িত্ব সংবিধান কার ওপর ন্যস্ত করেছে? এ বিষয়টি সাংবিধানিকভাবেই নিষ্পত্তি হতে হবে; নতুবা এ সঙ্কট থেকে জাতি মুক্তি পাবে না, বরং ফায়দা লুটবে সুবিধাভোগীরা।
ছুটির জন্য ক্যান্সার না ক্যান্সারের জন্য মি. সিনহার ছুটি? কোনো কথা গোপন থাকে না। যেমন গোপন থাকেনি বিচারপতি সিনহার ব্যক্তিগত বিষয় (যদিও এ বিষয়ে ডিফেন্ড করার সুযোগ তিনি এখনো পাননি)। এ জন্য জাতিকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। ক্ষতি যা হয়েছে, তা হলো ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান তথা বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে জনতার বিচারের মাপকাঠিতে বা ইতিহাসের পাতায় আসামির কাঠগড়া থেকে প্রধানমন্ত্রীও নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারবেন না। মোটা দাগে যদি কথাটি শেষ করতে চাই তবে বারবারই প্রশ্ন আসে- ক্যান্সারে আক্রান্ত কি বিচারপতি সিনহা না গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা?
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post