আমাদের বেশিরভাগ মানুষই রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে খুব বেশিকিছু আশা করে না। কিন্তু অং সান সু চির বেলায় আমরা আশা নিয়েই বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম। তার নামটি একসময় ছিল ভোগান্তির শিকার মানুষের মুখে ধৈর্য ও স্থিতিশীলতার ছাপ এবং স্বাধীনতার জন্য অনমনীয় সংগ্রামে সাহস ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতিরূপ। তিনি ছিলেন আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে রোহিঙ্গা পরিভাষাটি ব্যবহার না করার আবেদনের মধ্য দিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন এমন মানুষের পরিচয় একেবারেই অস্বীকার করে বসেছেন তিনি। আমার বন্ধুরা নিজেদের কর্মজীবনকে উৎসর্গ করেছেন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক আরোপিত আটকাদেশ থেকে সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ক্যাম্পেইনের জন্য। ১৯৯১ সালে শান্তিতে তার নোবেল জয়ের পর, ২০১০ সালে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে চূড়ান্তভাবে মুক্তির পর এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে যখন তিনি ও তার দল সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল, আমরা আনন্দ-উৎসব করেছি।
এগুলোর কিছুই এখনও ভোলা যায় না। এমনকি ভোলা যায়নি ভোগান্তির শিকার হওয়া সু চির প্রতি অনেক নির্মমতা- যার মধ্যে রয়েছে তার নির্বাসন, শারীরিক হামলা এবং সামরিক জান্তা কর্তৃক তার পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়গুলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তার কাছে যে উচ্চাশা ছিল তা বিশ্বাসঘাতকতায় রূপ নিয়েছে।
মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, যে কোনো মানদণ্ডেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। সু চি একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন, বর্তমানে তার ব্যবহার অদ্ভুত ঠেকছে। রোহিঙ্গাদের জাতিসংঘ নামকরণ করেছে ‘বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু’ হিসেবে, সু চি ক্ষমতায় আসার পরও এই বিশেষণের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
গণহত্যার শাস্তি ও গণহত্যা প্রতিরোধের সনদে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করা আছে, তার একটি এমন যে, যখন একটি জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী অথবা জাতিগত বা ধর্মীয় কোনো গ্রুপকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা নেয়া হয়, সেটাই গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রকাশ্যে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বড় ক্ষমতাশালী; কিন্তু সু চি তাদের ওপর কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না। আমি স্বীকার করি, তার কাজের সুযোগ সীমিত। কিন্তু যেহেতু বাস্তব ও আইনি কিছু পদক্ষেপ, যা তিনি এ গণহত্যা বন্ধে সরাসরি ব্যবহার করতে পারতেন, অথচ সম্ভব হচ্ছে না, তাই তার ক্ষমতার মধ্যেই থাকা একটি অস্ত্র অতি প্রাচুর্যের সঙ্গেই ব্যবহার করতে পারতেন আর তা হল কথা বলার ক্ষমতা। এই মোক্ষম অস্ত্রটি ব্যবহার না করে তিনি চুপ থাকছেন, স্বচ্ছ নথিভুক্ত প্রমাণকে অস্বীকার করছেন এবং বাধা দিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহায়তায়।
আমার সন্দেহ, ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের রিপোর্টটি সু চি পড়েছেন কিনা। এতে যে অপরাধ প্রকাশ পেয়েছে, এককথায় তা রোমহর্ষক। রিপোর্টটিতে নারী ও মেয়েদের গণধর্ষণের বিষয় নথিভুক্ত হয়েছে, যে নারী-মেয়েদের অনেকে যৌন নিপীড়নের কারণে আহত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে আরও দেখানো হয়েছে কী নৃশংসভাবে পরিবারের সদস্যদের সামনে শিশু ও বয়স্কদের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
জাতিসংঘের রিপোর্টে শিক্ষক, বয়োবৃদ্ধ ও গোত্রীয় নেতাদের হত্যার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। সেখানে হেলিকপ্টার থেকে বেপরোয়াভাবে অগ্নিবোমা নিক্ষেপ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এবং মানুষকে ঘরে বন্দি করে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলার বিষয়ও এসেছে। সর্বোপরি এক ঘটনায় অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে সেনাসদস্যরা এমনভাবে প্রহার করেছে যে, তার সন্তান ওই সময়েই ভূমিষ্ঠ হয়ে মারা যায়। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে মানুষকে ঘর থেকে বের করতে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, শস্যক্ষেত পুড়ে ফেলা, এমনকি পলায়নপর মানুষের নৌকায় গুলি করে হত্যার বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
এটা তো মাত্র একটা রিপোর্ট। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত বছর একই ধরনের নিপীড়নের একটি সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধ করা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যই। এটা কল্পনা করাও কঠিন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভয়ানক সন্ত্রাসের এ মাত্রা আরও তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশে পৌঁছা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ব্যাপকহারে গণহত্যার খবর দিচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের মাঝে অপুষ্টি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্তত ৮০ হাজার শিশু এর শিকার।
এগুলোর জবাবে অং সান সু চি এক সাক্ষাৎকারে এমন গণহত্যার জন্য কথিত বিদ্রোহীদের দায়ী করেছেন এবং তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, সরকার যখন রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক কিছু করছে, তখন কীভাবে তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তার এ বিস্ময় তিনিই সহজভাবে নিতে পারবেন, যিনি কখনও রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের উত্তরাংশে ভ্রমণ করেননি।
এটা সত্য, কিছু রোহিঙ্গা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে গত মাসে সর্বশেষ গণহত্যা শুরু হয়েছে। আরসা নামক একটি গ্রুপের হামলা এ সহিংসতা উসকে দিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত আরসার কাউকে বাদ দিয়ে গোটা জনসংখ্যার বিরুদ্ধে হামলা শুরু করেছে। এমনকি সহিংসতার প্রথম ১৫ দিনে অন্তত এক লাখ বিশ হাজার মানুষকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
সু চি তার নোবেল বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যেখানেই ভোগান্তিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই সংঘর্ষের বীজ রোপিত হয়। ভোগান্তি মর্যাদার হানি করে, তিক্ততার জন্ম দেয় এবং রাগ-ক্ষোভ সৃষ্টি করে।’ যেসব রোহিঙ্গা ক্ষোভের বশে অস্ত্র হাতে নিয়েছে, তাদের রাগকে জনগোষ্ঠীটিকে নিশ্চিহ্নকরণে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সু চি কেবল গণহত্যাকেই অস্বীকার করেননি, তিনি সামরিক বাহিনীকে নিন্দার হাত থেকে বাঁচাতে ঢাল হওয়ারও চেষ্টা করেছেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে তাদের রোহিঙ্গা না বলার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। এটা মূলত রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব অস্বীকার এবং তাদেরকে বাইরে থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার সরকারের নীতিরই অংশ। সু চি তার ফেসবুকের ওয়ালে রোহিঙ্গা ধর্ষণের ঘটনাকে ‘ফেক রেপ’ বলেছেন। তিনি জাতিসংঘ মিশনকে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, এমনকি তার সরকার রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো বন্ধ করে দিয়েছে।
সু চি এগুলো করছেন তার ভোট ঠিক রাখা, চীনকে খুশি রাখা এবং সামরিক বাহিনী যাতে তার ক্ষমতা কেড়ে না নেয়- এই সব কারণেই। একসময় তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতা দুর্নীতি করায় না; সেটি করায় ভয়। যারা ক্ষমতায় আছে তারা দুর্নীতি করে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে।’ কিন্তু এখন ভয়ের কারণে অন্যদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছেন তিনি, যা একসময় নিজের জন্য দাবি করেছেন। তার প্রশাসন হয় কিছু বিষয় বাদ দিচ্ছে বা চুপ থাকতে চাচ্ছে- অথচ এই কর্মীরাই একসময় সু চির অধিকারের স্বীকৃতির জন্য সহায়তা করেছিলেন।
এ সপ্তাহে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার বাতিলের একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করতে গিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, নোবেল কমিটির উচিত নিজেদের দেয়া পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দায় কাঁধে নেয়া। যে মূলনীতির কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়, পরবর্তীকালে তা ভঙ্গ করা হলে পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া উচিত। দয়া করে এ পিটিশনে স্বাক্ষর করুন। কারণ একজন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের দুষ্কর্মে এখন জড়িত।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান। লেখক: জর্জ মনবিয়ট, দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক।
Discussion about this post