মাসুদ মজুমদার
জনগণ মনে করে, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ভালো নেই। রাজনীতি অসুস্থ। সামগ্রিক অর্থনীতি অনেকটা মৃত্যুসজ্জায়। সংস্কৃতি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। সামাজিক অবক্ষয়- আইয়ামে জাহেলিয়াতের সীমা অতিক্রম করছে। শিক্ষাজীবনে নৈরাজ্য চলছে। দেশের বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন শুধু কবি আল মাহমুদের ভাষায় ‘ডাকাতদের গ্রাম’ নয়, ‘শিক্ষিত’ কিন্তু নীতিভ্রষ্ট দুর্নীতিবাজদের আখড়া। রাজনীতির বিনিময়ে শিক্ষামান বিকানো হচ্ছে। দলবাজ ভিসির নিজস্ব উচ্চাভিলাষ ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে কষ্টবোধে নীল হয়ে যাই। অথচ শিক্ষামন্ত্রীর বাগাড়ম্বর শেষ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ বানানোর মধ্যে। প্রশাসনে দক্ষতা ও সুশাসনের শুধু ধস নামেনি, একধরনের মড়ক লেগেছে। চেইন অব কমান্ড যেন ভেঙে পড়েছে। দলতন্ত্রের বিষাক্ত ছোবলে সেবাখাত ক্ষতবিক্ষত, অনেক ক্ষেত্রে সেবাও মুখথুবড়ে পড়ে আছে। সেবা কিনতেও ভোগান্তির শেষ নেই। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে সরকার শুধু খুন-জখম করেনি, এক প্রকার গলা টিপে হত্যা করেছে। জনগণের নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নিয়ে কী ন্যক্কারজনক আচরণই না করা হলো। আইনের লোকদের মাধ্যমেই আইনের শাসন বার বার চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ ও ‘নাই’ করে দেয়ার মিছিলে কত বনিআদম নিঃশেষ হয়ে গেছেন। জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। মামলাবাজির যে নজির স্থাপিত হলো, তার কোনো তুলনা হয় না। উচ্চ আদালত সরব হলেও মাঝে মাঝে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। নিম্ন আদালতের ব্যাপারে আমাদের মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতির দুঃখবোধ বিবেচনায় নেয়াই যথেষ্ট।
দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো সাগরচুরির নজির স্থাপন করছে। টেন্ডারবাজির জন্য দলীয় বাজিকরদের খুনোখুনি কার অজানা? উন্নয়নের ডুগডুগির ভেতর রাজধানীর চিত্র বেহাল। বাণিজ্যিক নগরীর অবস্থা আরো খারাপ। মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির জোয়ারে নাগরিকসমাজ ভাসছে। সর্বত্র সরকারি দলের ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য ও ঔদ্ধত্যের কারণে আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক সুবিচার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সেই সাথে, সুযোগ নিচ্ছে পেশাদার ডাকাত-চোর এবং দুর্নীতি রাজ্যের হার্মাদরা। সামাজিক ভারসাম্য বলতে অবশিষ্ট কিছুই নেই। সরকারি খাত মানে হরিলুটের বিষয়। ষোলো কোটি মানুষ যেন কষ্টদায়ক চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত।
বাস্তবে দেশে বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগের পরিবেশও নেই। ব্যাংকগুলো মোটেও ভালো নেই। রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়েছে। জনশক্তি রফতানি ধীরে ধীরে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জননিরাপত্তা বলতে যা বোঝায়, তার অনুপস্থিতি অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। ইভটিজিং থেকে ধর্ষণ নারীর প্রতি সহিংসতার এ পরিস্থিতি যেন অচেনা। সংসদ আছে সংসদীয় ধারার রাজনীতি অনুপস্থিত। সংসদে বিরোধী দল নিয়ে উপহাস করা যায়, রুচিকর কোনো মন্তব্য করা যায় না। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে যে নজির নেই, তাও এবার প্রত্যক্ষ করা গেল। সংসদে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা করুণ সুরে তার দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের অনুমতি চাইলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগের সাথে নির্বাহী বিভাগের টানাপড়েন কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত হতে পারে না। সর্বোচ্চ আদালতের সাথে সংসদের অনাকাক্সিক্ষত অবস্থান জাতিকে শুধু অসহনীয় মনোকষ্টের মধ্যে ছুড়ে দেয়নি, এক ধরনের অনিশ্চিত গন্তব্যের দুঃসংবাদ দিচ্ছে। সব শেষে আপিল বিভাগের রায় ও পর্যবেক্ষণ দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অজানা কোনো আলামত সৃষ্টি করতে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটি এখন আর গৌণ নয়। কেউ ভাবছেন, রাজনীতির শূন্যতা অনিবার্য হয়ে উঠছে। আরো একটি ‘এক-এগারো’র পদধ্বনি কি না- সে ব্যাপারে আগাম মন্তব্য করা কঠিন।
রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান খেলোয়াড়দের পরিচিতি সবার জানা, অদৃশ্য খেলোয়াড়রা কে কার জন্য কবর খুঁড়ছেন বলা মুশকিল। তবে সবাই ধারণা করছেন এবার আর রাজনীতির অঙ্ক দু’য়ে দু’য়ে চারের মতো মিলে যাবে না। প্রকৃতিও যেন বৈরী হয়ে উঠেছে। হাওর-বাঁওড় থেকে রাজধানী, গ্রাম থেকে নগর বন্দর কোথাও মানুষ স্বস্তিতে নেই। সমাজের স্থিতি নষ্ট হয়ে গেছে। এমন সব আকাম-কুকাম ও অনাচার ছড়িয়ে পড়েছে, যা কোনো সমাজে প্রত্যাশিত নয়। ধার্মিক মন গজবের আশঙ্কায় ভীত। দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। সৃষ্টিলোকে অনাচার স্রষ্টার ভেতর ক্ষোভের জন্ম দেয়। ক্ষোভ নানাভাবে গজবের মাধ্যমে আপতিত হয়।
আজকের ভীতিকর ও অস্বস্তিময় পরিস্থিতি শাসকদের এবং শাসকাশ্রয়ীদের হাতের কামাই। কেউ কারো দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান নন। যার যার অবস্থানে সবাই বাড়াবাড়ি করে চলেছেন। অতীত জাতি ও সভ্যতাগুলোর বিলুপ্তি কিংবা ধ্বংস হওয়ার কারণগুলোর সাথে বর্তমান পরিস্থিতির মিলই বেশি। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ত্রাণকর্তা খুঁজে বেড়ায়। মন্দের ভালো খুঁজে ফেরে। জাতি যেন আজ সেখানেই এসে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের ক্রান্তিকালে সামান্যতেই দ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ইতোমধ্যে সাধারণ কিছু ইস্যুতে বিচ্ছিন্ন ছাত্র-জনতা ফুঁসে ওঠার প্রমাণ মিলেছে। এমন পরিস্থিতিতে মহাপ্লাবনের মতো ধেয়ে আসে বিপদ-আপদ। অদৃষ্টবাদীদের কাছে এর কারণ অদৃষ্ট। নিয়তিবাদীরা নিয়তির ওপর দোষ চাপিয়ে চোখ বুজে থাকেন। হিন্দু পুরাণে এর ব্যাখ্যা ঈশ্বরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ; খ্রিষ্টানদের ভাষায় এর সবই পাপের ফসল।
ইহুদিরা বলেন, ধর্মের পথ থেকে পদস্খলনের পরিণতি; প্রকৃতিপূজারীরা ভাবেন প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা বলেন, রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি ও দুঃশাসনের খেসারত। অর্থনীতির ভাষায়, সব সূচকের এক সাথে পতনের আলামত। অশনিসঙ্কেত। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সমাজে গড়ার চেয়ে ভাঙার লোক বেড়ে গেলে এমনটি হয়। আধুনিক বিজ্ঞান প্রকৃতি জগতে সব ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির জন্য মানুষকেই দায়ী করে।
ইসলাম বিপথগামী মানুষের সীমালঙ্ঘনে খোদায়ী আজাব-গজব নাজিলের একটা বিধির কথা বলে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সমাজের ভালো মানুষও রক্ষা পায় না। যা সব, আহলে কিতাব তথা বাইবেলের ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট এবং কুরআনের অনুসারীদের অবস্থান এককাতারে এনে দেয়; অনেকটা বিশ্বাসীদের একই সমতলে অবস্থানের মতো। তবে সব কিছুর মধ্যে গজবের আলামত অনুসন্ধান করা, গজবের আশঙ্কা আত্মসমালোচনা ও বিশ্বাসের দাবি পূরণ করলেও সঙ্কট উত্তরণের এবং জাগৃতির স্বপ্ন দেখায় না।
বর্তমান সঙ্কট মানুষের সৃষ্টি। বিশেষত রাজনীতিকদের সৃষ্টি করা কোনো সঙ্কট যখন রাষ্ট্রাচারকে ঘিরে ধরে তখন রাজনীতির ফর্মুলায় সমাধান খুঁজতে হয়। সে ক্ষেত্রে অন্যায্য আস্ফালন এবং ক্ষমতার দম্ভ সমাধানের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে। যুক্তির ভাষা হারিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতেই মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে হঠকারী হয়ে পড়ে।
এ জন্যই বলা হয়, রাজনৈতিক বাড়াবাড়ির উদর থেকে যে সঙ্কট জন্ম নেয়, তার উত্তরণ রাজনৈতিক দাওয়াই দিয়েই করতে হয়। গণসম্মতির রাজনীতিতে ফিরে এলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সহনীয় মাত্রায় এসে যায়। দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতাই পারে অনিশ্চয়তার ঘনঘোর অন্ধকারের ভেতর আশার আলো ফুটাতে।
সব পক্ষকে বিবেচনায় নিতে হবে দল ও জোট ভাঙা-গড়ার নেপথ্যে অনেক লবি সক্রিয়। রাজনীতির মাঠে এখন দৃশ্য-অদৃশ্য অনেক খেলোয়াড়। সবার গোলপোস্ট একমুখী না হলেও ক্ষমতার রাজনীতির জন্যই এই প্রতিযোগিতা। তবে আওয়ামী লীগ নিরাপদ রাজনীতিকে প্রাধান্য দিতে চাইলে সমঝোতার বাইরে কোনো পথই মসৃণ নয়, ঝুঁকিমুক্তও নয়। দলটির নেতৃত্ব টেরই পেল না, মাত্র ক’টা দিনের মধ্যেই তারা নিজেদের জনগণ থেকে কিভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। চার দিক থেকে নিñিদ্র নিরাপত্তার যে দেয়াল খাড়া করার জন্য নেতৃত্ব মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন- তা আর আগের জায়গায় নেই। সব দিক থেকে চ্যালেঞ্জগুলো ধেয়ে আসছে।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post