আলফাজ আনাম
সভ্য সমাজে অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন, তাকে শাস্তি দেয়া হয় বিচারের মাধ্যমে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বেশকিছু মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে, অনেক রায় কার্যকরও হয়েছে। তবে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়া হয়েছে। কারণ মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়ার পর তা আর ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই। নির্দোষ ব্যক্তি যাতে কোনোভাবেই চরম দণ্ড না পায়, সেজন্য সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। উন্নত দেশের অনেক বিচারক এ ধরনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়ে থাকেন। সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো মৃত্যুদণ্ডের বিধান রদ করার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। অপর দিকে, বাংলাদেশে যেকোনো উপায়ে মানুষ হত্যা এখন একটি সহজ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ দেশে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেমন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে, তেমনি বিনা বিচারে বা বিচারবহির্ভূতভাবে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে।
দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা বেড়েই চলছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বহু নেতাকর্মী হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডকে নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত কারণে হত্যা বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ পুলিশ বা র্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড থামছে না। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যে মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৮৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৯ জন ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। একই সময়ে ৫৭ জন মানুষ গুম হয়েছেন বলে দাবি করেছে ‘অধিকার’। এর মধ্যে ছয়জনের লাশ পাওয়া যায়, ২৫ জনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। অধিকার বলছে, গুম হওয়া ২১ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
হত্যা ও গুমের এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত যে, দেশে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা ও গুম করার অপসংস্কৃতি চলছে। ফলে মানুষের মধ্যে এখন ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা বা ভূমিকা কতটুকু, তা নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা ছিল। সেই অস্পষ্টতা অনেকটা নিরসন করেছেন ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য। ঢাকা-১৯ আসনের নির্বাচনী তৎপরতার খবর পরিবেশন করতে গিয়ে এই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সংসদ সদস্যের সাথে কথা বলছিলেন একটি দৈনিকের প্রতিবেদক। ওই আসনের সংসদ সদস্য ডা: এনামুর রহমান বলেন, ‘সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল। এখন সব পানি হয়ে গেছে। কারো টুঁ-শব্দ করার সাহস নেই। পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, আরো ১৪ জনের লিস্ট করেছি। সব ঠাণ্ডা। লিস্ট করার পর যে দু-একজন ছিল তারা আমার পা ধরে বলেছে- আমাদের জানে মাইরেন না, আমরা ভালো হয়ে যাবো।’ (মানবজমিন, ১৯ জুলাই ২০১৭)।
সংসদ সদস্যের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট- সাভার এলাকায় বিনা বিচারে অন্তত পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততা আছে। তিনি আরো ১৪ জনের তালিকা করেছেন। এই খবরে এলাকায় নিশ্চয়ই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সংসদ সদস্যের এই বক্তব্যের পর স্থানীয় যুবদলের একজন নেতা জানিয়েছেন, ‘সংসদ সদস্যের এই বক্তব্যের পর সত্যিকার অর্থেই তিনি আতঙ্কে রয়েছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য কাকে কখন ক্রসফায়ারে দেয়া হয়, তার তো কোনো ঠিক নেই।’ (প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০১৭)।
সংসদ সদস্য পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এবং সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে এ বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, ১৪ জনের লিস্ট করেছি’ শিরোনামে গত ১৯ জুলাই দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ক্রসফায়ারসংক্রান্ত আমার যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তা অনভিপ্রেত, অশোভনীয় ও নিন্দনীয়। প্রকৃতপক্ষে আমি যে বিষয়ে আলোকপাত করতে চেয়েছিলাম, তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে না পারায় বক্তব্যের রূপ বিকৃত হয়ে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করেছে, যা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বক্তব্যের জন্য আমি লজ্জিত, দুঃখিত ও জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আমার অনাকাক্সিক্ষত, অবিবেচনাপ্রসূত এ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। এই বক্তব্য আমার একান্তই নিজের। এর দায়দায়িত্বও আমার নিজের। এর সাথে দল বা সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বা তাদের নীতির সাথেও ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। একই সঙ্গে, এ ব্যাপারে কাউকে বিভ্রান্ত না হওয়ারও বিনীত অনুরোধ করছি।’
সংসদ সদস্য তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন; সে কারণে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। তিনি নিজেও উপলব্ধি করেছেন- একজন সংসদ সদস্যের উচিত নয় এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত হওয়া কিংবা হত্যার তালিকা করা। তার এই বক্তব্যে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে। ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের এই বক্তব্যে শুধু যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আতঙ্কে থাকবেন তা নয়, দলের মধ্যে তার যে প্রতিপক্ষ আছে, তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন। বাকি ১৪ জনের তালিকায় কারা আছেন তা নিয়ে অনেকের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করবে। তারপরও সাভারের সংসদ সদস্যের এই উপলব্ধি থেকে ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতারা শিক্ষা নেবেন বলে আমরা আশা করি। তিনি তার এই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, তার নির্বাচনী এলাকায় বিনা বিচারে হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তিনি অনেকটা সরলভাবে এসব ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা বা প্রভাব বিস্তারের কথা স্বীকার করেছেন।
এই সরল স্বীকারোক্তি ধরেই বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার দিকটি বিবেচনায় নিতে হবে। দেশে যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ড ও গুমের ঘটনা ঘটছে তা শুধুই আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়। এর সাথে রাজনীতির গভীর সংযোগ রয়েছে। এই রাজনীতির বলি যে সব সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হবেন তাও নয়, অনেক সময় অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্যও এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ক্ষমতাসীন দলের কোন্দলে স্থানীয়পর্যায়ের ৪০ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অনেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতার পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক গ্রুপ থাকে। এ ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে আগামী দিনে দলের কোনো কোনো নেতা ক্রসফায়ারের শিকার হবেন না তার নিশ্চয়তা নেই। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছিল। যারা খুন হয়েছেন তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দমনের কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করতে গিয়ে এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদে দলটির সাড়ে ৬০০ নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১৪০ জন গুম রয়েছেন, যার মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে রয়েছে ৪০ জন। জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে বেআইনিভাবে আটক করে গোপন স্থানে আটকে রেখেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত ৩২০ জনের বেশি মানুষ গুম হয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে অভিযুক্ত আসামি, সেনাসদস্য ও বিরোধী দলের সমর্থক। এদের মধ্যে ৫০ জনকে পরে হত্যা করা হয় এবং ডজনের মতো এখনো ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন। অপহরণের শিকার কিছু লোককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে অথবা আদালতে হাজির করা হয়েছে। এ ধরনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এখনো ঘটছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সমর্থকদের নিখোঁজ করা হচ্ছে।’’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এ অভিযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।’ এর আগেও বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। জানুয়ারি মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভাড়ায় খাটা একটি সংগঠন। দলটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এখন ভাড়ায় কাজ করে, ভাড়া খাটে। পয়সার বিনিময়ে বিবৃতি দেয়। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে এরা ভাড়ায় কাজ করে। বিএনপি-জামায়াতের নিয়োগ করা মিলিয়ন ডলারের লবিস্ট ফার্মের তৈরি করা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।’
আমরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনের দাবিকে অস্বীকার করতে পারি। এমনকি দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এজেন্ডা নিয়েও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না। তেমনি ঢাকা-১৯ আসনের সংসদ সদস্য যে সত্য উচ্চারণ করেছেন, তা-ও অস্বীকার করা যাবে না। সর্বাগ্রে সরকারের উচিত আইনের শাসন নিশ্চিত করা; অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা; বিচারের বাইরে কাউকে শাস্তি না দেয়া। মনে রাখতে হবে, এসব হত্যাকাণ্ডের দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। ক্ষমতাসীন মহলের রাজনৈতিক নেতারা এই দায় এড়াতে পারেন না। এমন কাজ যে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করছে না, সংসদ সদস্য ডা: এনামুর রহমানের দুঃখ প্রকাশ করে দেয়া বক্তব্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিষয়টি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post