চার দিন চলে গেলেও কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারের অপহরণের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। তিনি (ফরহাদ মজহার) এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। এমনকি প্রথমদিকে মুখ খুললেও অজ্ঞাত কারণে তার পরিবারের সদস্যরা এখন নিশ্চুপ। অপহরণ নিয়ে তারা কোনো কথা বলছেন না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফরহাদ মজহারের বরাত দিয়ে যেসব তথ্য দিয়েছে, এগুলোও যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্নের। দিন দিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে রহস্যের জট। একমাত্র ফরহাদ মজহার মুখ খুললেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
শুক্রবার দিনভর চেষ্টা করেও তার পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষের চাপ আছে কিনা, সে বিষয়টিও স্পষ্ট করছেন না ফরহাদ মজহারের পরিবারের কেউ। ফরহাদ মজহার শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার কেবিন নম্বর ১১০৬।
ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনার পর থেকে জনমনে তৈরি হওয়া নানা প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল যুগান্তরকে বলেন, এর আগে অনেকেই অপহরণের পর গুম হয়েছেন। যারা সৌভাগ্যক্রমে ফিরে এসেছেন তারা কোনো কথা বলেননি। এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজনরাও এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
ফরহাদ মজহার ফিরে আসার পর এখন পর্যন্ত মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পুলিশের বরাত দিয়ে অনেক কথা শুনেছি। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন তার আগে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয়নি। এতে তার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে।
তিনি যেসব কথা বলছেন, তা মুক্ত মানুষের মতো বলছেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে তিনি কোনো কথা বলবেন কিনা, তা-ও জানি না। ফরহাদ মজহারের অপহরণ নিয়ে লুকোচুরি করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, এই ঘটনাটি রহস্যজনক। এর রহস্য উন্মোচন করতে হবে। যারা অপহরণ করেছে, যারা সহযোগিতা করেছে তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য মিলিয়ে তদন্তকারীরা একটি উপসংহারে পৌঁছলে রহস্য উন্মোচন হবে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে অনেক তথ্য প্রকাশ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ঘটনার সত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তদন্তকারীরা তদন্ত করছেন। তারা আশ্বস্ত করেছেন এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করবেন। জনগণ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদ মজহার ইচ্ছে করে ঘটনা ঘটিয়েছেন, নাকি অন্য কোনো কারণে এটি সংঘটিত হয়েছে, তা বের করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কোনো সুপরিচিত ব্যক্তি এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে, অনেকেই এর রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে। সরকারের প্রতি দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। আর বাংলাদেশে খুন-গুমের একটি অভিযোগ তো বিভিন্ন মানিবাধিকার সংস্থা প্রকাশ করছে। তদন্তে যদি বেরিয়ে আসে ফরহাদ মজহারের ঘটনার পেছনে সরকারি কোনো বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা নেই, তাহলে অতীতে যেসব গুমের অভিযোগ এসেছে, সে দাবি হালকা হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নিখোঁজের ১৯ ঘণ্টা পর উদ্ধার হলেও তাকে কারা, কী উদ্দেশ্যে অপহরণ করেছে তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগ নিয়ে যে রহস্য তৈরি হয়েছে, তাও উদ্ঘাটিত হয়নি। খুলনা থেকে ঢাকায় ফেরার বাসের টিকিট কে কেটেছিল- এ নিয়েও রয়েছে নানা রহস্য। অপহরণের পর ফরহাদ মজহারের অবস্থান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছয়বার চিহ্নিত করেছিল। তারপরও কেন সারা দিন অভিযান চালানো হয়নি, এমন প্রশ্ন অনেকের।
তিনি যখন খুলনার হোটেলে খাচ্ছিলেন তখন আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছিল। তারপরও কেন তাকে তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি, তা নিয়েও সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন। রাতে তাকে কে ফোন করে বাইরে নিয়ে গেছে, এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেননি সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ফরহাদ মজহার অপহরণ মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে এখন পর্যন্ত এ ঘটনার রহস্য ভেদ করা যায়নি।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) হাফিজ আল আসাদ যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনাটি রহস্যজনক। ফরহাদ মজহারের বক্তব্য, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সোমবার ভোরে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। ওই দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগর এলাকায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর প্রথমে ফরহাদ মজহারকে খুলনায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে মঙ্গলবার সকালে তাকে ঢাকার আদাবর থানায় আনা হয়। পরে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে পাঠানো হলে সেখানে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
কথা বলেননি কেউ : ফরহাদ মজহার রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুক্রবার দুপুরে ১১০৬ নম্বর কেবিনে নক করলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন ফরহাদ মজহারের পারিবারিক বন্ধু এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উবিনিগ-এর পরিচালক সীমা দাশ।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহার অপহরণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানাননি। তাছাড়া তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণে এ বিষয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তবে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মানসিকভাবে তিনি এখনও বিপর্যস্ত।
তার স্ত্রী ফরিদা আখতার ও মেয়ে সমতলী হক কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা কোথায় এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। পরে ফরহাদ মজহারের বাসা শ্যামলীর রিং রোডের জেনেটিক গার্ডেন হাউসে গেলে প্রধান নিরাপত্তা কর্মী মোহাম্মদ আলী ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি।
তিনি বলেন, ভেতরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আছে। পরে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন রিসিভ করেন একজন নারী। তিনি ফরিদা আখতারকে ফোনটি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরে তিনি একজন পুরুষকে ফোনটি দেন। ওই ব্যক্তি জানান, ফরিদা আখতার কথা বলবেন না। ফরহাদ মজহারের মেয়ে সমতলী হক কোথায় জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি জানান, সমতলী বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। কেন, কী কারণে তিনি হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন এ নিয়ে তিনি কিছু জানাননি।
পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে উবিনিগ-এর পাবলিক রিলেশন্স অফিসার আবদুল জব্বার বলেন, সমতলী হক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আইন পেশায় আছেন। গত ৭ জুলাই তিনি দেশে আসেন। বৃহস্পতিবারই তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। আগে থেকেই বিমানের টিকিটও কাটা ছিল। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তার কিছু সিডিউল প্রোগ্রাম আছে। এ কারণে তিনি ফিরে গেছেন।
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post