লিয়াকত হোসেন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সুইডেনে কর্মব্যস্তময় দিন পাড়ি দিয়ে গেলেন। সুইডেন প্রবাসী বাঙালি এবং দেশের ষোল কোটি বাঙালির গর্বের বিষয়, কারণ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধানের এই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। অবশ্য এর আগে মজলুম জননেতা মউলানা ভাসানী ও অনান্য নেতা এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন উপলক্ষে সুইডেন সফর করেছেন তবে সে গুলো রাষ্ট্রীয় সফর ছিলোনা। এজন্যই প্রধানমন্ত্রীর এই সফরটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই রাষ্ট্রীয় সফরে সুইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্ম্পক জোরালো ও উন্নয়নের ভূমিকা রাখবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী র্আলান্দা বিমান বন্দরে অবতরন করেন বুধবার দিবাগত রাত নয়টা চল্লিশ মিনিটে। সেখানে তাঁকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অফ অনার দেয়া হয়। এবং বিমান বন্দরে সুইডেনের বৈদেশীক বিভাগের চীফ প্রটকল অফিসার ক্লস মলিন সুইডেনের পক্ষে সংবর্ধনা জানান। সে সঙ্গে ছিলেন সুইডেনের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম সারওয়ার ও বাংলাদেশে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ইয়াহান ফিসেল। জনাব ক্লস মলিন এক বিশিষ্ট ব্যাত্তিত্ব, কিছুদিন আগেও তিনি থাইলেন্ডের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং এর আগে লাওস, মিয়ানমার ও ফিলিপিনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তবে মন্ত্রীর পদর্মযাদায় নন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রী পর্যয়ের কেউ সংবর্ধনা জানালে সেটা শোভন হতো বেশী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১৪ এবং ১৫ই জুন বৃহস্পতি ও শুক্রবার খুব কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাভের সঙ্গে দেখা করা, প্রধানমন্ত্রী ষ্টেফান লোভেন, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লোভিন, আইনমন্ত্রী মরগান জোহানসন, ডেপুটি স্পীকার টোবিয়াস বিলস্ট্রুমের সঙ্গে দেখা করার মধ্য দিয়ে। এই দুটি দিন প্রধানমন্ত্রী যেন ছুটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু এ সবই আমরা জেনেছি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের ব্রিফিং ও বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রথম আলো, যুগান্তর, Daily Star, Financial express ও অনলাইন ভিত্তিক পত্র-পত্রিকা মারফত। সুইডেনের প্রভাবশালী দৈনিক Daily Dagens nyheter, Daily Svenska dagbladet, সন্ধ্যাদৈনিক Expressen, Aftonbladet ও অনান্য পত্রিকাগুলো সর্ম্পূনভাবে প্রধানমন্ত্রীর আগমন, কার্যক্রম ও নির্গমন এড়িয়ে গেছে। বিষয়টি বেদনাদায়ক, বেদনাদায়ক আরো এই জন্য যে এটিই সরকারীভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সুইডেন সফর।
বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সুইডেন সফরের দুইদিন আগে সুইডেন সফর করে গেছেন মায়ানমারের ষ্টেট কাউন্সেলর আং সান স্যু কাই। এটিও ছিলো রাষ্ট্রীয় সফর। দুই দিনের সফরে আং সান স্যু সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ষ্টেফান লোভেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালষ্ট্রুম, বানিজ্যমন্ত্রী আন লিনডে, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লোভিন এবং তিনি সুইডিশ পার্লামেন্ট স্পীকার উরবান অলীনের আমন্ত্রনে সংসদে ভাষন প্রদান করেন। সুইডিশ মন্ত্রী পরিষদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালষ্ট্রুম খুবই পাওয়ারফুল আর প্রধানমন্ত্রী ষ্টেফান লোভেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষীক আলোচনার পর আং সান স্যু কাই সাংবাদিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সুইডিশ সাংবাদিক ও মিডিয়া আং সান স্যু কাই এর প্রতিটি পদক্ষেপ ও খবর তাঁর বর্নাঢ্যময় জীবনী গুরুত্ব সহকারে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে। সাংবাদিক সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেন। আং সান স্যু কাই দক্ষতার সঙ্গে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। মায়ানমারের আং সান স্যু কাইয়ের সফরের মত বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর বর্ণাঢ্যময় হতে পারতো, কিন্তু তা হয়নি।
১৫ই জুন বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সিটি কনফারেন্স সেন্টারে বাংলাদেশী কমিউনিটির দেয়া এক সংবর্ধনায় বক্তব্য রাখেন। বিস্তারিত রিপোর্ট এসেছে ষোল তারিখের প্রথম আলোয়। বত্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নতুন কিছু বলেননি, সেই গতানুগতিক ডঃ ইউনুস, গ্রামীণ ব্যাংক, হিলারী ক্লিনটন, পদ্মা সেতু, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি যা সচরাচর বাংলাদেশ সংসদেও বলা হয়ে থাকে। দেশে ও বিদেশে একই কথা। প্রকৃত আওয়ামী লীগাররাও এইসব শুনে এখন বিরক্তি প্রকাশ করেন।
গত ১৫ই জুন সুইডেনের বিশিষ্ট ম্যাগাজিন Om världen (about the world) বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী ও মায়ানমারের আং সান স্যু কাইয়ের সুইডেন সফর বিষয়ক দীর্ঘ তিন পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। উক্ত রিপোর্টে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী, র্যাব ও মানবাধিকার লংঘনের কঠোর সমালোচনা করা হয়। প্রশ্ন করা হয় এখনো সুইডেন বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রতি বছর ২৫০ মিলিয়ন ক্রোনার সাহায্য দিয়ে থাকে তবু মানবাধিকারের উন্নতি নেই, সাহায্য বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সুইডেনের রয়েছে দীর্ঘ সম্পর্ক। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুইডিশ জনগন অর্থ সংগ্রহ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছে। এই দীর্ঘ সু-সম্পর্কের উপর কালো ছায়া নেমে আসে যখন মন্ত্রীপরিষদের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালষ্ট্রুম গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রিরুদ্ধে মানবতা লংঘনের অভিযোগ আনয়ন করেন। ঐ এপ্রিল মাসেই সুইডিশ রেডিও বাংলাদেশের জনৈক র্যাব অফিসারের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কিভাবে বন্দিদের উপর অত্যাচার ও মানুষ গুম করা হয়। সাক্ষাৎকার প্রচারের পর পরই সুইডিশ জনগন নড়েচড়ে বসে। প্রবাসীদের মধ্যেও চাঞ্চল্য দেখা দেয়। অনেকেই সাক্ষাৎকারটি বানোয়াট এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের রোড মডেলের বাধা স্বরূপ আখ্যায়িত করে সুইডিশ মিডিয়ার উপর চড়াও হন। কিন্তু আমরা একটি জিনিস ভুলে যাই যে সাংবাদিক হিসেবে সুইডেনে সহজেই নাম লেখানো যায়না, উপযুক্ত তথ্য প্রমানাদি না থাকলে কোন রিপোর্টার রিপোর্ট লিখেননা। এখানে তথ্য প্রযুক্তির ৫৭ ধারা না থাকলেও সাংবাদিকরা জবাব দিহিতার উর্দ্ধে নন বলেই সাংবাদিকতার এথিক মেনে চলেন।
গত ১৫ই জুন সুইডিশ রেডিওর বেট্রিস জনসন প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুইডেন সফরটি একপ্রকার গোপন রাখা হয়। এখন অ্যামনেষ্টি আশা করে সুইডিশ সরকার বাংলাদেশের মানবতা বিরোধী কার্যক্রমের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইবে। সুইডেনের অ্যামনেষ্টির প্রেসিডেন্ট অ্যামি হেডেনবার্গের সভাপতিত্বে অ্যামি হেডেনবার্গ বলেন,“নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে ব্যাপক দমন-পীড়ন রয়েছে। আমরা এটির সমাধান চাই। এটি জানা যায়না কখন বাংলাদেশ হতে এই সফরের সূচনা করা হয়। যদিও বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর এই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর তবুও সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়নি। বিষয়টি এতই সংবেনশীল যে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকারের অভাবের উন্নয়ন সম্পর্কে মানবাধিকার সংগঠন গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন।”
তথ্য সূত্রঃ
১. প্রথম আলো, যুগান্তর, Daily Star, Financial express ১৪-১৫-১৬ জুন, ২০১৭
২. Om världen, Sweden’s walkover on human rights in Bangladesh, 15 june, 2017,
৩. Swedish Redio, Beatrice Janzon, 15 June 2017
৪. ছবি, ইন্টারনেটের সৈজন্যে
ষ্টকহোম, সুইডেন
১৮-৬-২০১৭
Discussion about this post