শাহদীন মালিক
আইনের শাসনকে আজকাল বিস্তর খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। এই খোঁজাখুঁজি করছেন স্বয়ং হর্তাকর্তারাও। একজন সহজেই খুঁজে পাচ্ছেন। আরেকজন বলছেন, আইনের শাসন নেই। উনি খুঁজে পাচ্ছেন না। এতে আমরা বলাবাহুল্য বিভ্রান্ত হচ্ছি, সত্য নিয়ে পেরেশানিতে পড়ছি। এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে অন্য কোথাও পাওয়া না গেলেও আইনের শাসনকে এখন পাওয়া যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম ইত্যাদি অতি বৃহৎ ও নামীদামি হাসপাতালে। দণ্ড পাওয়া দামি দামি দাগি আসামি সেখানে মাসের পর মাস নিবিড় চিকিৎসায় থেকেও সুস্থ হতে পারেন না। কিন্তু যেই খবরের কাগজে তাঁদের খবর আসে, অমনি মেরুদণ্ডের ব্যথায় শুয়ে থাকা লোকটি দাঁড়িয়ে পড়েন। সংবাদ পাঠের দু-এক দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে আবার কারাগারে ফিরে যান। জেলখানা কর্তৃপক্ষ যাঁদের ধরে রাখতে পারে না, দেশের সেরা চিকিৎসকেরাও যাঁদের দুরারোগ্য অসুখ সারাতে পারেন না, তাঁরা দিব্যি সুস্থ অবস্থায় কারাগারে ফিরে যান।
হাসপাতালে আইনের শাসনের কেচ্ছা বলি। পরিচিত ভদ্রলোক, রাজনৈতিক নেতাও বটে তিনি। দু-চারবার তাঁর সঙ্গে বাসায় আড্ডা হয়েছিল। একদিন কথা বলতে বলতে খাবার সময় হয়ে গেল। বললাম, যা আছে সেটা খাওয়ার আমন্ত্রণ। ঘটনাচক্রেই বাসায় ওই দিন ইমপ্রুভড ডায়েট। মুরগি ছিল, ছিল দুই পদের মাছ। সঙ্গে তরিতরকারি। খেতে বসে ভদ্রলোক এটা খেতে পারি না, ওটা খেতে মানা, সেটা খাওয়ায় অস্বস্তি। শেষ পর্যন্ত একটুকু সবজি আর ডাল খাওয়া সারলেন। বোঝা গেল, শরীরে হরেক ব্যাধি বাসা গেড়েছে। বাসার লোকেরা তাঁকে টাইটেল দিল, আপনার ‘কিছু-খেতে-পারে-না বন্ধু’। যেহেতু সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ নন, সেহেতু অচিরেই তাঁর স্থান হলো জেলখানায়। দুই ভীষণ মামলায় অভিযুক্ত করে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, পাঠানো হলো রিমান্ডে। ১৩ দিন রিমান্ডে থাকার পর মধ্যষাটের এই নেতা হয়ে পড়লেন ভীষণ অসুস্থ। রিমান্ডে ১৩ দিন ডিবির রাজপ্রাসাদের থাকার ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। তাঁকে নিতে হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। তারপর জেলখানায়। দিন যায়, মাস যায়। অনেক রোগের রোগী এই নেতাকে বারবার নিতে হয়েছিল হাসপাতালে। জামিন হয় না। সব রোগের কাগজপত্র দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে আদেশ পেলাম হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসার।
আগে প্রতিবারই এক-দুই দিন হাসপাতালে রেখে আবার জেলে ফেরত পাঠানো হতো। হাইকোর্টের আদেশের পরে ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত তাঁর ভালো চিকিৎসা হবে। হাইকোর্টের আদেশের পরে আপিল বিভাগের দিকে নজর রাখিনি, কারণ ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি চিকিৎসার ব্যাপারেও সরকারের ভীষণ আপত্তি থাকবে। তিন দিনের মাথায় খবর পেলাম, খোদ অ্যাটর্নি জেনারেল গেছেন আপিল বিভাগে চিকিৎসার আদেশ বাতিল করার জন্য। পরদিনই জানা গেল, আদালতের আদেশের অপেক্ষা না করে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার ফেরত নিয়ে গেছে জেলখানায়। চিকিৎসা শুরু হয়েছিল, শেষ আর হয়নি।
সন্ত্রাসী নন, খুনি নন, মাদক ব্যবসায়ী নন, একমাত্র দোষ উনি সরকারের বিরোধিতা করেন। আসি বর্তমানে। স্পষ্টতই, যত বড় খুনি, সন্ত্রাসী বা দেশজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন মাদক ব্যবসায়ী, সুযোগ-সুবিধা তত বেশি। তা তিনি জেলের বাইরেই থাকুন বা থাকুন জেলের ভেতরে, প্রায় সর্বত্রই তাঁরা বিশেষাধিকারভোগী। সর্বোচ্চ আদালত লম্বা কারাবাসের শাস্তি দিলেও জেলেই যে থাকতে হবে, এমন তো কথা নেই। দিনের পর দিন মাসের পর মাস, মোবাইল, রেডিও-টেলিভিশন-ফ্রিজ-এয়ার কন্ডিশনার, সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভার, ব্যক্তিগত সহকারী—সব নিয়ে থাকা যায়। সার্বক্ষণিক ডাক্তার তো আছেনই গন্ডায় গন্ডায়। বড় হাসপাতালের সুচিকিৎসার সব ব্যবস্থাসহ, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের, এমনকি পত্রিকার সাংবাদিকদেরও আনাগোনার সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত।
স্পষ্টতই, এ দেশে এখন সবকিছু ‘ম্যানেজ’ হয়। ‘ম্যানেজ করা’ আইনের শাসন আছে। এই আইনের শাসন সব সময় দেখতে পায়। কিন্তু যে আইনের শাসনে আমির-ফকির সবার ব্যাপারে সমানভাবে আইন প্রয়োগ হয়, সেই আইনের শাসন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লেটেস্ট—গুলশানের ধর্ষণের অভিযুক্ত দুই ধনীর দুলাল আসামিকে পুলিশ কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। আশা করি, আইনের শাসন আবার ‘ম্যানেজ’ হয়ে যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post