২০২৪ সালের আগস্টে বহুল প্রতীক্ষিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল যে, গুম, খুন, দলীয় দখলদারি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার যুগ শেষ হবে। কিন্তু প্রায় এক বছর পূর্ণ হলেও দেশে কোনো মৌলিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং অতীতের ভয়াল দিনগুলোরই পুনরাবৃত্তি যেন চোখের সামনে ঘটে চলেছে।
সম্প্রতি দুটি ভয়াবহ ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক অপরাধ রাষ্ট্রযন্ত্রের গঠনমূলক ব্যর্থতা এবং আইনের শাসনের দুর্বলতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে—একটি গাইবান্ধায় ছাত্রশিবির নেতা সিজু মিয়ার নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং অন্যটি ঢাকায় বসুন্ধরার ই-ব্লকে একটি কনভেনশন সেন্টারে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সরকার উৎখাতের সামরিক প্রশিক্ষণ আয়োজন।
গাইবান্ধার ঘটনায় ইসলামি ছাত্রশিবিরের নেতা সিজু মিয়াকে পুকুরে পিটিয়ে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে এক নারীর কণ্ঠে চিৎকার শোনা যায়: “বাবা সাব্বির, হায়রে বাবা, আর মারিস না বাবা, মরে যাবে।” এই সাব্বির, যাকে ভিডিওতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত দেখা যায়, সে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মাহমুদ হাসান রিপনের ঘনিষ্ঠ বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। লাশ উদ্ধার হয় সাঘাটা থানার পাশের পুকুর থেকে, অথচ পুলিশ নির্বিকার। থানার গেটের পাশেই থাকা সাব্বিরের বাবার দোকান হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বন্ধ। সন্ত্রাসীরা এমনই আত্মবিশ্বাসী, যেন তারা জানে—তাদের কিছুই হবে না। আট দিন পেরিয়ে গেছে, অথচ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ কীভাবে এত সংগঠিতভাবে হত্যা করে এবং পুলিশের ছায়াতলে পালিয়ে থাকতে পারে? রাষ্ট্র যদি নিষিদ্ধ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সহযোগিতা করে, তবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো আসলে কার হাতে পরিচালিত হচ্ছে? জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের হাতে, নাকি গোপন সিন্ডিকেটের দ্বারা?
অন্যদিকে, ঢাকার অভিজাত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে ঘটে আরেক ভয়াবহ ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিক আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে পরিকল্পিত সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিলেন। সিসিটিভি ক্যামেরা সারাদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। সেখানে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা এবং গোপালগঞ্জের আওয়ামী নেত্রী শামীমা নাসরিন। শুধু তাই নয়, এর আগে ঢাকার আরও চারটি স্থানে এমন প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সব ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনা প্রকাশের পর সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে মেজর সাদিক হেফাজতে আছেন এবং তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই দুই ঘটনাই এক গভীর সত্য তুলে ধরে—সন্ত্রাসের রূপ এখন দ্বিমুখী। একদিকে রাষ্ট্রের নিষিদ্ধ সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে সেই সন্ত্রাসকে আশ্রয় দেওয়া, লালন করা এবং প্রয়োজনে সামরিকভাবে ব্যবহারের ষড়যন্ত্র। গাইবান্ধায় হত্যা, বসুন্ধরায় সরকার উৎখাত পরিকল্পনা—এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং বাংলাদেশের রাজনীতির পুরনো কালো ছায়ারই ধারাবাহিকতা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এই সকল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে, যে সরকার জনগণের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু গত এক বছরে প্রশাসনিকভাবে তারা কার্যত ব্যর্থ। পুলিশ এখনো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ‘লেজুড়বৃত্তিক’ আচরণ থেকে বের হতে পারেনি। বিচারব্যবস্থা, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, সীমান্ত নিরাপত্তা—সবখানেই স্থবিরতা। সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজি, টাকাপাচার—কোনও ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সরকারকে সহায়তার জন্য নিয়োজিত উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকেই প্রশাসনিকভাবে নিস্ক্রিয় এবং কার্যত দায়িত্বহীন।
গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের চরিত্র যদি না বদলায়, তাহলে সন্ত্রাস, হত্যা, ষড়যন্ত্র—সবই থেকে যাবে পুরোনো ধাঁচে। গাইবান্ধায় একজন নাগরিককে থানার পাশেই মেরে ফেলা হয়, ঢাকায় রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে সেনা কর্মকর্তা সরাসরি নেতৃত্ব দেয়, অথচ প্রশাসন নির্বিকার। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা শুধু তাদের দক্ষতার প্রশ্ন নয়, বরং এটি একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতার সংকট।
এখন সময়, অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের শুধরে নেওয়ার। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভেঙে অপরাধী যেই হোক—তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নিষিদ্ধ সংগঠনের বিরুদ্ধে কেবল ঘোষণায় নয়, কার্যকর বাস্তবতায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে। আর সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
রাষ্ট্র যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক হতে চায়, তবে এই দুমুখো সন্ত্রাসের জবাব তাকে দিতেই হবে। নয়তো জনগণ বিশ্বাস হারাবে, এবং সেই শূন্যতা পূরণে আবারও চোর, ডাকাত আর সামরিক ষড়যন্ত্রকারীরাই ঘুঁটি সাজাবে।
লেখক: গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
ওর্গানাইজিং সেক্রেটারি, ফাইট ফর রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, লন্ডন।
Discussion about this post