২০১৪ সালে আলোচিত এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের কাছ থেকে ১,৫০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এস আলম গ্রুপের ১,৩০০ মেগাওয়াটের একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানোর যন্ত্রপাতি কেনায় কর ফাঁকির সুবিধা দেবার অফার দিয়ে এই ঘুষ হাতিয়ে নেন জয়। আর তাতে প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা কর দিতে হয়নি এস আলম গ্রুপকে।
শুক্রবার ভারতীয় গণমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজের চন্দন নন্দীর এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে। ভারতের ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্টকে (ইডি) দেওয়া জবাবনবন্দিতে জয়ের ঘুষ নেবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদার। এস আলম হলেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
জয়ের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হওয়া ছাড়াও রিপোর্টে — ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এস আলমের ১,৫০০ কোটি টাকা প্রদান এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, ডিজিএফআই, আইজিপি এবং আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে তাতেও ব্যবসায়ী এস আলমের প্রভাব খাটানো–এসকল তথ্যও উঠে এসেছে।
ভারতের ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্টের (ইডি) সদস্যদের হাতে পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে গ্রেফতারের এক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা (এনআরবি গ্লোবাল ব্যাঙ্কের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার) জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তাদের জানান যে, ২০১৪ সালে ১,৫০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ইডির এ সংক্রান্ত তথ্যের নথি নর্থইস্ট নিউজের কাছে পৌঁছেছে।
ইডির তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলমকে ব্যবসার বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেবার বিনিময়ে তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের আত্মীয়-স্বজন এবং সহযোগিরা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা সাইফুল আলমের সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি রিলায়্যান্স ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড এর চেয়ারম্যান।
পিকে হালদার ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রিলায়্যান্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। ইডিকে দেওয়া জবানবন্দিতে পিকে হালদার বলেন, “২০১৪ সালে বাংলাদেশে ১,৩০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট বানাতে আর্থিক এবং কারিগরি সংক্রান্ত বিষয়ে চায়নিজ একটি গ্রুপের সঙ্গে সমঝােতা করতে আমাকে দায়িত্ব দেন সাইফুল আলম।”
তিনি বলেন, “পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানোর জন্য প্রাথমিকভাবে খরচ ধরা হয়েছিলো ১.৫-১.৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রতারণামূলকভাবে জমির চড়া দাম দেখিয়ে সেই খরচ দেখানো হয় প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার। পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণ খরচও বাড়িয়ে হিসেব দেখান সাইফুল আলম। এই পাওয়ার প্ল্যান্টের খরচের টাকা নেওয়া হয় সাইফুল আলমের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে।”
ইডিকে পিকে হালদার বলেন, “পাওয়ার প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতি আমদানিতে যে রাজস্ব ট্যাক্স দেবার কথা তা দিতে হয়নি সাইফুল আলমকে। আর এতে সাইফুল আলমের কোম্পানিকে প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়নি। বাংলাদেশের সরকারই তাকে এ সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর এ জন্য সজীব ওয়াজেদ জয়কে ১,৫০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে সাইফুল আলমকে।”
গত ২ বছর ধরে বাংলাদেশে জনসম্মুখে দেখা যায়নি সজীব ওয়াজেদ জয়কে। ধারণা করা হচ্ছে তিনি বিদেশে নিজের অবস্থান গোপন রেখে বসবাস করছেন। এই ২ বছরে মাঝে মাঝে তাকে ওমান এবং যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে।
ইডির নথিপত্রগুলো স্বাধীনভাবে যাচাইয়ের সুযোগ পায়নি নর্থইস্ট নিউজ। তবে ইডির পাবলিক প্রসিকিউটর অরজিত চক্রবর্তী ২০২২ সালের জুলাই মাসে বলেন, পিকে হালদার জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাঘা বাঘা ব্যক্তিদের নাম বলে দিয়েছেন। সরাসরি কারো নাম না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত। এরপর থেকে আদালতের নিয়মিত মামলার কার্যক্রম ছাড়া ইডির এই মামলাটির কার্যক্রম আর এগোয়নি।
২০২২ সালের ১৪ মে ৫ সহযোগীসহ অশোকনগর থেকে পিকে হালদাকে গ্রেফতার করে ইডির সদস্যরা। ইডির মামলার নথি অনুসারে জানা যায়, পিকে হালদারের ১১টি বাড়ির বিষয়ে অভিযান চালানোর সময়ে এই ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তাদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।
ইডির ১৫ মে’র একটি নথি থেকে জানা গেছে, পিকে হালদার এবং তার সহযোগিরা প্রতারণার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড এবং আধার কার্ড বাগিয়ে নিয়েছে। এমনকি এসব ভূয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তারা ভারতে বিভিন্ন কোম্পানি খুল বসে এবং পশ্চিমবঙ্গে সম্পত্তি ক্রয় করে।
গত বছর ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করার অনুরোধের পর গভীর তদন্তে নামে ইডি। তদন্তে ব্যাপক দুর্নীতি আর ঘুষ নেবার চিত্র উঠে আসে। এ অনুসন্ধানে বাংলাদেশে ১০,০০০ কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি আর বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি জানা যায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের ভূয়া পাসপোর্ট ছাড়াও পিকে হালদারের কাছে গ্রেনাডার পাসপোর্টও পাওয়া যায়। এসময় পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড কর্ণার নোটিশের বিষয়েও জানতে পারে ইডি।
পিকে হালদার ইডিকে বলেন, “ছয়টি ব্যাংক, একটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ২ টি সাধারণ বীমা কোম্পানি এবং ২ টি জীবন বীমা কোম্পানির ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সাইফুল আলমের। নিজের ৩ টি কোম্পানিকে ব্যবহার করে সাইফুল আলমের মালিকানায় রয়েছে ২ টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এছাড়া ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তার সদস্যপদ রয়েছে।”
পিকে হালদার বলেন, “ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোশাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মোট ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকে সাইফুল আলমের কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সময়ে এই চার ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয় অন্য ব্যাংকের পরিচালকদেরকে। এর মধ্যে রয়েছেন আইএফআইসি ব্যাংকের মালিক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।”
সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সাইফুল আলম এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো ২০,০০০ কোটি টাকারও বেশী ঋণ নিয়েছে বলে জানান পিকে হালদার।
ইডিকে দেওয়া জবানবন্দিতে পিকে হালদার বলেন, “সাইফুল আলম তার অঢেল টাকার সুবাধে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বাংলাদেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান–দুর্নীতি দমন কমিশন, ডিজিএফআই, আইজিপি এবং আইন মন্ত্রণালয়–এগুলোর শীর্ষ পদে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তাতে প্রভাব খাটান তিনি।”
আওয়ামী লীগ এবং হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেবার বিষয়টি ইডির নথিতে জানা গেছে। পিকে হালদার বলেন, “২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন সাইফুল আলম। অনুদানের টাকার মধ্যে সাইফুল আলমের ২ টি কোম্পানি থেকে ১০০ কোটি টাকার অনুদান আমি নিজে ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”
Discussion about this post