এখন থেকে ২৪১ বছর আগে এই বঙ্গে জন্ম নিয়েছেন এক অসাধারণ ব্যক্তি। যিনি মুশরিক ও নাসারাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজের সারাজীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এদেশের মুসলিমদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী চেতনা জাগ্রত করেছেন। এদেশের তাওহীদবাদীদের সমস্যা মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আজ ২৭ জানুয়ারি। শহীদ মাওলানা সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর রহ.-এর জন্মবার্ষিকী।
শহীদ মাওলানা তিতুমীরের পত্রবাহক আমিনুল্লাহর শাহদাতের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক জিহাদের প্রস্তুতি শুরু হয়। অথচ মাওলানা তিতুমীর চেয়েছিলেন এই জিহাদ আরো কিছু সময় পরে শুরু করতে। কারণ বাংলার মুসলিমরা দীর্ঘদিনের নাসারা ও মুশরিকদের আগ্রাসনের কবলে পড়ে দূর্বল ঈমানদার হয়ে পড়েছিলো। অনেক শিরক ও বিদআত তাদের কর্ম, চিন্তা ও আচরণে পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। তাই মাওলানা তিতুমীর চেয়েছিলেন আগে মুসলিমদের আকিদা ঠিক করতে। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনে তিনি জিহাদে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন।
১৮৩১ সালের ১৪ই নভেম্বর মিঃ আলেকজান্ডার একজন হাবিলদার, একজন জমাদার এবং পঞ্চাশজন বন্দুক ও তরবারিধারী সিপাহী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার তিনক্রোশ দূরে বাদুড়িয়া পৌছেন। বশিরহাটের দারোগা সিপাই-জমাদারসহ বাদুড়িয়ায় আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়। উভয়ের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল একশ’ বিশজন। অতঃপর যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় তাতে উভয়পক্ষের লোক হতাহত হয়, গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে মুসলমানদের বীরত্ব দেখে আলেকজান্ডার বিস্মিত হন এবং দারোগা ও একজন জমাদার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। বেগতিক দেখে আলেকজান্ডার প্রাণরক্ষার্থে পলায়ন করেন। বন্দুক নিয়েও সে যাত্রায় জিততে পারেনি ব্রিটিশ এই ম্যাজিস্ট্রেট। উভয়ের পক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষতক জান নিয়ে পালিয়ে যান আলেকজান্ডার। তিতুমীরের হাতে বন্দী হয় এক দারোগা ও জমাদ্দার। পালিয়ে যাওয়ার সময় নদীতে ডুবে মৃত্যু হয় জমিদার কৃষ্ণদেব রায়।
জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার বারাসাত প্রত্যাবর্তন করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকটে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার আবেদন জানিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্ণেল স্টুয়ার্টকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করে তার অধীনে একশত ঘোড়-সওয়ার সৈন্য, তিনশত পদাতিক দেশীয় সৈন্য, দু’টি কামানসহ নারিকেলবাড়িয়ার অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। ১৯ নভেম্বর রাত্রে কোম্পানী সৈন্য নারিকেলবাড়িয়া পৌঁছে গ্রাম অবরোধ করে রাখলো।
ইংরেজদের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ক্ষণ এসেছিলো তখন তিনি তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে রাখা প্রেরণাদায়ক বক্তব্যে বলেছেন,
“ওহে ঈমানদার বীর ভাইয়েরা!
একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই। এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য, ইসলামের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যাদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে। ইনশাআল্লাহ”
– শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর রহ.
(শাহাদাতবরণের আগের দিনে প্রদত্ত বক্তব্য)
শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে মাওলানা তিতুমীর ও তাঁর লোকেরা মজবুত বাঁশের খুঁটি দিয়ে নারিকেলবাড়িয়া ঘিরে ফেলেছিলেন যা ইতিহাসে “তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা” বলে অভিহিত আছে। বিশাল ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে তিতুমীর শাহাদত বরণ করেন। তাঁর মৃতদেহকে ইংরেজ সৈন্যরা অমানবিকভাবে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। তিতুমীর ও তাঁর শিষ্যদের বাড়ি-ঘর লুন্ঠন করে সেদিন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো। সেনাপতি গোলাম মাসুমকে সরকার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো। তাছাড়া ১১ জনের যাবজ্জীবন এবং ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক হান্টারের মতে, ‘তিতুমীর তার অধিকৃত এলাকায় স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রজা আন্দোলন একটি গণবিপ্লব ছিলো। কৃষক ও তাঁতীরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদার ও নীকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। অত্যাচার, অবিচার ও অপমানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিতুমীরের নেতৃত্বে প্রজাগণ লড়াই করে আত্মসম্মান ও ন্যায় মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলো।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে নারিকেলবেড়িয়ায় তিতুমীর শহীদ হয়েছেন। তবে মাওলানা সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, গোলাম মাসুম ও তাদের দলীয় লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে অথবা প্রতিপক্ষের কাছে আনুগত্যের মস্তক অবনত না করে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ধীরস্থির হয়ে যেভাবে শত্রুর মুকাবিলা করে শাহাদাতের অমৃত পান করেছেন তা একদিকে যেমন ইতিহাসের অক্ষয় কীর্তিরূপে চির বিরাজমান থাকবে, অপরদিকে অসত্য ও অন্যায় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রামের প্রেরণা ও চেতনা জাগ্রত রাখবে ভবিষ্যতের মানবগোষ্ঠীর জন্যে। ইতিহাস স্বীকার করতে বাধ্য যে, ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়ানো এবং উপমহাদেশে মুসলিমদের স্বাধীন ভূমি তিতুমীরদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। তিতুমীরেরা বাংলা ও ইসলামের জন্য এবং সর্বস্তরের মানুষের আত্মসম্মান-আত্মমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যুগে যুগে লড়াই করেছেন, রক্ত এবং প্রাণ দিয়েছেন।
Discussion about this post