সালমান আল-আযামী
যখন টি২০ ক্রিকেট শুরু হয়, তখন টেস্ট ও ওয়ান ডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খুব দুর্দশা। তখন অনেকে মনে করেছিল এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের ভাল করার সম্ভাবনা বেশী, কারন আমাদের ক্রিকেটারদের ধৈর্য কম, তাই এই ফরম্যাট আমাদের ক্রিকেটারদের জন্য উপযোগী। প্রায় দুই যুগ হয়ে গেল টি২০ ক্রিকেটের, কিন্তু বাংলাদেশের সাফল্য ক্রিকেটের সবচেয়ে আধুনিক ও জনপ্রিয় এই ভার্শনে এখনো সোনার হরিণের চেয়ে বেশী দুষ্প্রাপ্য একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়ান ডে তে আমরা এখন ভাল দল। টেস্টে এখনও দুর্বল হলেও টি২০ ক্রিকেটে আমাদের পারফর্মেন্স সবচাইতে খারাপ। কি কারনে খারাপ তার বিশ্লেষণ হচ্ছে অহরহ, কিন্তু ফলাফল কিছুই হচ্ছেনা, কারন আমার মতে আমরা গোড়ায় কি সমস্যা না বুঝেই চিকিৎসায় নেমে যাচ্ছি। আজকের এই লিখায় আমি আমার দৃষ্টিতে টি২০ ক্রিকেটের ১১টি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আমার যুক্তিগুলো ঠিক কি না তা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন।
১। পাওয়ার হিটার না থাকা
যে যাই বলুক, টি২০ ক্রিকেটে পাওয়ার হিটারের বিকল্প নেই, যা বাংলাদেশে একজনও নেই। অনেক চিন্তা করেও কেন নেই এর কারন খুঁজে পাচ্ছিনা। যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এত এত পাওয়ার হিটার থাকে, তবে আমাদের নেই কেন? আমাদের দেশে ১৪০/৫০ স্ট্রাইক রেটের কোন ব্যাটসম্যান আছে? নেই। অথচ ভারতে সুর্যকুমার যাদব, হার্দিক পান্ডিয়া, পাকিস্তানে আসিফ আলী, খুশদিল শাহ, শ্রীলংকায় শানাকা, হাসারাঙ্গা, আফগানিস্তানে রাহমানুল্লাহ, নাজিবুল্লাহ সহ অনেক পাওয়ার হিটার আছে। এদের অধিকাংশের শারীরিক গঠন আমাদের খেলোয়াড়দের মতই। যতদিন পর্যন্ত স্পেশালিষ্ট পাওয়ার হিটার পাওয়া না যাবে যারা শেষ তিন ওভারে ১২-১৫ রান করে প্রতি ওভারে করতে পারে, ততদিন পর্যন্ত একটি শক্তিশালী টি২০ দল গড়া কঠিন। এই এশিয়া কাপের কথাই ধরুন। প্রায় প্রতি খেলায় শেষ ৪ ওভারে ৪৪/৪৫ রান চেস হয়ে যাচ্ছে। শ্রীলংকাতো আমাদের সাথে ৮ উইকেট হারানোর পরও শেষ ২ ওভারে ২৫ রান করে ফেলল। আমাদের দেশে কে আছে যে এই কাজ করতে পারে?
২। ব্যাটসম্যানদের ইন্টেন্টের অভাব
ইন্টেন্ট বা মেরে খেলার ইচ্ছা এখন আমাদের ক্রিকেটে একটি বড় আলোচনার বিষয়। এশিয়া কাপে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে খেলাটি ছাড়া অনেকদিন থেকে এই ফরম্যাটে আমাদের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইন্টেন্ট দেখা যায়নি। দু একজন ছাড়া বাকী সবাইকে মনে হয়েছে দলকে জেতানো নয়, দলে টিকে থাকার জন্য তারা খেলছে। টি২০ ক্রিকেটে রিস্ক নিতেই হবে। ১৭০/৮০ রান না করলে জেতার সম্ভাবনা নেই জানা থাকলেও ব্যাটিং ইন্টেন্ট আমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। আশার কথা এই যে সাকিব ও শ্রীরামের এই নতুন যুগে শ্রীলংকার সাথে খেলায় এই ইন্টেন্ট কিছুটা দেখা গেছে। তবে এই জন্য ব্যাটসম্যান সিলেকশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি বিশ্বকাপের দল গঠনে এই দিকটি খেয়াল রাখা হবে।
৩। মুখস্থ অধিনায়কত্ব
জিম্বাবুয়ে সফরের আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করেছেন, এবং তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ টি২০ ক্রিকেটে কেবল পিছিয়েছে। বেশ কয়েকটি ম্যাচে বাংলাদেশের পরাজয়ের পেছনে রিয়াদের মুখস্থ অধিনায়কত্বকে দায়ী করা যায়। ক্রিকেটে ‘ম্যাচ আপ’ বলে একটি কথা আছে যাতে দেখা যায় যে ডান হাতি ব্যাটসম্যানের জন্য বা হাতি বোলার ও বা হাতির জন্য ডান হাতি বোলার ব্যাবহার করতে। কিন্তু এটা খোদাই করা কোন জিনিষ নয়। বা হাতি বা ডান হাতি – যখন একজন বোলার ভাল বল করে, তখন ব্যাটসম্যানরা সমস্যায় পড়ে। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ এটা কখনও বুঝতেননা। অনেকবার দেখা গেছে যে সাকিব ভাল বল করছেন, কিন্তু একজন বাম হাতি ব্যাটসম্যান আসার সাথে সাথে সাকিবকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, বা মাহেদী বা মোসাদ্দিক ভাল বল করছেন, কিন্তু ডান হাতি কোন ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে তাদের বল দেয়া হচ্ছেনা ভাল বল ও উইকেট নেয়া সত্ত্বেও। গত বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যখন ভাল অবস্থানে এবং সাকিব খুব ভাল বল করছেন, তখন বা হাতি ব্যাটসম্যান আসার সাথে সাথে আফিফকে দিয়ে বল করানো হল, এবং সে ওভারে শ্রীলংকা ১৫ রান নিয়ে বাংলাদেশকে চাপে ফেলে দিল। সে খেলায় বাংলাদেশের সেরা বোলার সাকিব তার ৪ ওভারের কোটা পূরণ পর্যন্ত করতে পারেন নি।
আশার কথা হচ্ছে সাকিব মুখস্থ অধিনায়কত্ব করবেন না, কারন তার ক্রিকেটীয় ব্রেন খুব ভাল এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারনে ম্যাচের অবস্থার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি পারদর্শী। দেখা যাক এর প্রতিফলন বিশ্বকাপে দেখা যায় কিনা।
৪। ফিনিশারের অভাব
এক সময় মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আমাদের ফিনিশার ছিল। সাব্বির রহমানও এই ভুমিকা পালন করেছেন মাঝে মাঝে। দু একবার মুশফিক আমাদের ম্যাচ জিতিয়েছেন। কিন্তু গত ২/৩ বছরে টি২০ ক্রিকেট যেভাবে এগিয়েছে, আমাদের ক্রিকেট সেভাবে এগুতে পারেনি। মাহমুদুল্লাহ ও মুশফিকের খেলায়ও সেই ধার আর নেই। টি২০ ক্রিকেট এখন আই পি এল, বিগ ব্যাশ, দি হান্ড্রেড ইত্যাদি ফ্রাঞ্চাইজ টুর্নামেন্টের বদৌলতে অনেক এগিয়েছে এবং ব্যাটসম্যানদের স্কিল এবং শট খেলার সামর্থ্য এক ভিন্ন পর্যায়ে চলে গেছে। অন্যদিকে বোলাররাও রান আটকানোর বিভিন্ন নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু এসব টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাদের খেলোয়াড়রা বিশ্ব ক্রিকেটের সাথে তাল মিলিয়ে এগুতে পারছেনা। এর ফলাফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। শেষ ৩ ওভারে ৩৫ রান করার মত কোন ফিনিশার বাংলাদেশের এই দলে আমি অন্তত: দেখতে পাচ্ছিনা।
৫। ডেথ বোলিং এ দুর্বলতা
ডেথ বোলিং একটি আর্ট যা সবাই পারেনা। এক সময় মুস্তাফিজ এ ব্যাপারে স্পেশালিষ্ট ছিল যার কারনে তার আই পি এলেও চাহিদা ছিল। কিন্তু বর্তমান মুস্তাফিজের মধ্যে সেই এক্স ফ্যাক্টর আর নেই। গত দু বছরে দেশের বাইরে তার বোলিং পারফরমেন্স খুব খারাপ। এই এশিয়া কাপেই আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে এক ওভারে ১৭ রান দিয়ে মুস্তাফিজের কারনেই ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে গেল। আমাদের আর কোন বোলার তো মুস্তাফিজের ধারে কাছেও নেই ডেথ ওভারে বল করার জন্য। এর কারনে অনেক জেতা ম্যাচ আমরা হেরে যাচ্ছি। শ্রীলংকার ৯ এবং ১০ নম্বর ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে তাই আমরা শেষ ২ ওভারে ২৫ রান দিয়ে ম্যাচ হেরে গেলাম। ডেথ ওভারে তারাই সফল যাদের বোলিং এ ভেরিয়েশন আছে, যারা ভাল ইয়র্কার করতে পারে এবং যারা এক যায়গায় বল করতে পারে। আশা করি এই যায়গায় বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করতে পারবে। তা না হলে আফগানিস্তান ও শ্রীলংকার কাছে যেভাবে ম্যাচ হেরেছি, তেমন পরাজয় অব্যাহত থাকবে।
৬। লেগ স্পীনারের অভাব
আমার অবাক লাগে এই ভেবে যে এত বছরেও আমরা একজন লেগ স্পিনার তৈরী করতে পারলামনা। টি২০ ক্রিকেটের অন্যতম ট্রাম্প কার্ড লেগ স্পিনার। বর্তমান বিশ্বের টি২০ দলগুলোর দিকে তাকালে পরিষ্কার হয়ে যাবে কিভাবে লেগ স্পিনাররা এই ফরম্যাটে রাজত্ব করছে। অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডাম জাম্পা, ইংল্যান্ডে আদিল রশিদ, নিউ জিল্যান্ডে ইশ সোধী, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাব্রীজ শামসি, ভারতে ইয়ুজবিন্দ্র চাহাল, পাকিস্তানে শাদাব খান, আফগানিস্তানে রশিদ খান, শ্রীলংকায় হাসারাঙ্গা – এরা সবাই শুধু যার যার দেশের অপরিহার্য বোলারই নন, তারা ফ্রাঞ্চাইজ লীগগুলোতেও দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমাদের দেশের দিকে তাকালে দৃশ্য একেবারে ভিন্ন। জাতীয় দল তো দুরের কথা, দেশের ফার্স্ট ক্লাস ও টি২০ ক্রিকেটে কোথাও লেগ স্পিনার খুঁজে পাওয়া যায় না। যুবায়ের লিখন ও আমিনুল বিপ্লবদের দিয়ে দু একবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তারা আবার দ্রুত হারিয়েও গেছে। কি কারনে লেগ স্পিনার তৈরী হচ্ছেনা তা নিয়ে ভাবাটা খুব জরুরী, কারন ভাল লেগ স্পিনার দেশে না থাকায় আমরা লেগ স্পিনারদের বিরুদ্ধে খেলতেও খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা। আর রশিদ খানের মত বোলার বল করতে আসলে আমাদের ব্যাটসম্যানদের অবস্থা কত করুন হয়ে যায় তা আর বলার প্রয়োজন হয় না। জানি না এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কবে সমাধান হবে।
৭। আন্তর্জাতিক ফ্রাঞ্চাইজ লীগ খেলার অভিজ্ঞতা না থাকা
বিশ্বের ফ্রাঞ্চাইজ লীগগুলো এখন টি২০ ক্রিকেটের গতি নির্ধারণ করছে। এটা কারও ভাল লাগুক আর না লাগুক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই কারনেই এখন ৫০ ওভারের ক্রিকেটের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তাই একে একে বড় ক্রিকেটাররা ৫০ ওভারের ক্রিকেটকে বিদায় বলছেন। সেই ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটে বাংলাদেশীদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। সাকিব ও মুস্তাফিজ ছাড়া আর কেউ কোন দলে ডাক পায়না। আর এবারতো আইপিএলে সাকিবও ডাক পেলেন না। অথচ আফগানিস্তানের ৫/৬ জন বিভিন্ন দেশের টি২০ টুর্নামেন্টে নিয়মিত খেলছে, যার ফলে তাদের খেলার স্কিল অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা এমন যে ভাল মানের টি২০ খেলোয়াড় না থাকায় ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটে আমাদের খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন হয় না। আর ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা না থাকায় এর প্রভাব খেলোয়াড়দের পারফরমেন্সে পড়ছে। এর থেকে উত্তরণের দুটি উপায় আছে বলে আমি মনে করি – প্রথমত: আমাদের দেশের বিপিএল এর মান বাড়ানো এবং এতে দেশীয় খেলোয়াড়দের পারফরমেন্স ভাল হওয়া, আর দ্বিতীয়ত: আমাদের জাতীয় টি২০ দলের পারফরমেন্সের মাধ্যমে আমাদের খেলোয়াড়দের ফ্রাঞ্চাইজ দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হওয়া। এই দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই টি২০ ক্রিকেটে আমরা ভাল দল হতে পারব।
৮। প্রতিযোগিতামূলক টি২০ খেলার অভাব
একদিকে আমাদের খেলোয়াড়রা ফ্রাঞ্চাইজ টুর্নামেন্ট দেশের বাইরে খেলতে পারে না, তার উপর আমাদের দেশে প্রতিযোগিতামূলক টি২০ ক্রিকেট বেশী খেলতে পারেনা। অনেক সময় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের মাধ্যমেই আমাদের ছেলেরা টি২০ খেলার অভিজ্ঞতা লাভ করে। যদি বেশী বেশী প্রতিযোগিতামূলক টি২০ ক্রিকেট খেলতে না পারে, তবে এই ফরম্যাটে ভাল খেলোয়াড় তৈরী হবে কিভাবে? উন্নতিই বা কিভাবে হবে? আমাদের দেশীয় ক্রিকেট ওয়ান ডে ক্রিকেটে বেশী গুরুত্ব দেয়, অথচ বিশ্বে এখন টি২০ ক্রিকেটের জয়-জয়াকার। ক্রিকেট বোর্ডকে ভাবতে হবে যে আমরা বিশ্ব ক্রিকেট থেকে আলাদা নই, তাই সবার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের টি২০ ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রতিবারের ব্যর্থ মিশনের পর বোর্ড কর্মকর্তারা বড় বড় কথা বলেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
৯। দুর্বল নার্ভ
আমরা সবাই জানি যে টি২০ ক্রিকেট হচ্ছে হাই ভোল্টেজ খেলা যেখানে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান একটি ওভারেই হয়ে যেতে পারে। তাই এই খেলায় ভাল করতে হলে মানসিক শক্তির জোর দরকার। নার্ভ শক্ত না হলে এই খেলায় জয় পাওয়া দুষ্কর। এশিয়া কাপেই সেটা দেখতে পেলাম আমরা। আফগানিস্তান ও শ্রীলংকা উভয় দলের বিরুদ্ধেই আমরা জয়ের অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও হেরে গেছি, কারন নার্ভের খেলায় প্রতিপক্ষ আমাদের থেকে ভাল ছিল। আমরা অসহায়ের মত দেখতে থাকলাম কিভাবে নাজিবুল্লাহ জাদরান আমাদের সেরা বোলার মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে নার্ভের খেলায় জয়ী হল, বা শ্রীলংকার ৯ ও ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান আমাদের ইবাদতের এক ওভারে কেমন করে ২২ রান নিয়ে হারিয়ে দিল। নার্ভের খেলায় আমাদের পরাজয়ের অন্যতম প্রমান সেই খেলায় অনেকগুলি ওয়াইড ও নো বল করা। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ক্যাচ ছাড়া, রিভিউ ভালভাবে নিতে না পারা ইত্যাদি সবকিছুই ঐ দুর্বল নার্ভেরই ফসল। এই সমস্যার সাথে প্রতিযোগিতামূলক খেলার অভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যারা আইপিএল খেলে তারা এত বেশী টেনশনের ম্যাচ খেলে যে খেলার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো তারা ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে পারে। আর এখানেই আমাদের খেলোয়াড়রা মার খেয়ে যায়।
১০। বোর্ডের অযথা হস্তক্ষেপ
কয়েক সপ্তাহ আগে ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে আমার লিখাটিতে আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের বেশী বেশী কথা বলা ও অযথা হস্তক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম। আমাদের দেশের মত আর কোন বোর্ড এত বেশী হস্তক্ষেপ করে বলে আমার জানা নেই। এই লিখা যেদিন প্রকাশ হবে সেদিনই বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করার কথা। সম্প্রতি এক টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হল যে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে নেয়া হবে কিনা তা নাকি বোর্ড সভাপতি ঠিক করবেন।এটা কেমন কথা? এটা কি তার জব ডেসক্রিপশনে পড়ে? দল ঘোষণা করবে নির্বাচক কমিটি অধিনায়ক ও কোচের পরামর্শে। এতে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির কি কাজ? নির্বাচক কমিটিতে দুই সাবেক অধিনায়ক ও এক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছেন। আমাদের অধিনায়ক বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। আরও আছেন টেকনিক্যাল কনসাল্টেন্ট শ্রীরাম ও টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন যে নিজেও একজন সাবেক অধিনায়ক। পাপন সাহেবতো একজন রাজনীতিবিদ যে রাজনৈতিক কারনেই ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হয়েছেন – সৌরভ গাঙ্গুলী বা রমিজ রাজার মত নিজ যোগ্যতায় সভাপতি হন নি। তিনি কেন ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত দেবেন? তার কাজ ক্রিকেট বোর্ডের নেতৃত্ব দেয়া – দল নির্বাচন নয়। এ ধরনের হস্তক্ষেপ আর কোন দেশে দেখা যায় না। আমাদের ক্রিকেট উন্নয়নে এই হস্তক্ষেপ এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১১। প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অমিল
প্রতিবার আমরা যখন এই ফরম্যাটে আমরা খেলতে নামি, তার আগে আমাদের বোর্ড ও সাংবাদিকরা এমনভাবে আশার বানী শোনায় যে দর্শকদের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তারপর যখন দল যথারীতি ব্যর্থ হয়, তখন শুরু হয় গালাগালি। সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার পরও একই দৃশ্য অংকিত হতে দেখা গেল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এশিয়া কাপের সুপার ফোরে উঠতে না পারা কি অপ্রত্যাশিত ছিল? আমরা কি আমাদের সামর্থ্যের থেকে খারাপ খেলেছি? আমরা কি এই ফরম্যাটে সত্যিই শ্রীলংকা ও আফগানিস্তান থেকে ভাল? আমার দৃষ্টিতে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরই ‘না’। আমরা অবশ্যই সুপার ফোরে উঠার যোগ্য দল ছিলামনা এবং যেসব দেশ যোগ্য, তারাই পরবর্তী রাউন্ডে খেলেছে। যদি আমাদের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত হত, তবে আমাদের পারফরমেন্সের প্রতিক্রিয়াও সে রকমই হত। এখানে যেসব কারন আমি উল্লেখ করলাম তা কি আমাদের বোর্ড বা সাংবাদিকরা জানেনা? আমি অবাক হয়ে গেলাম দুদিন আগে যখন খালেদ মাহমুদ সুজন সাংবাদিকদের বলছিলেন যে রহিত শর্মা বা বিরাট কোহলীর চাইতেও নাকি আমাদের খেলোয়াড়দের ভাল শট খেলার যোগ্যতা আছে। তাই নাকি? তিনি সত্যিই তাই ভাবেন? এই বাচালতা আমাদের দেশের ক্রিকেটের উন্নতির আরেকটি বাধা। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলী নয় – যদি সুর্যকুমার যাদব বা কে এল রাহুল তৈরী করতে পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে তবে আপনারা সবার দোয়া পাবেন। যারা সাংবাদিক, তাদের প্রতি অনুরোধ, সারাক্ষণ খবরের জন্য আমাদের ক্রিকেট নিয়ে দর্শকদের হাইপ না বাড়িয়ে ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক প্রতিবেদন লিখুন। আর আমরা যারা দর্শক, তারা আমাদের দলকে পাকিস্তান বা ভারত মনে না করে বাস্তব প্রত্যাশা নিয়ে খেলা দেখলে, এবং হেরে গেলে দুনিয়া শেষ হয়ে গেল এই ভেবে অকথ্য ভাষায় গালাগালি না করে, আর আমাদের দলকে ভবিষ্যতে ভাল খেলার জন্য উদ্বুদ্ধ করলে আমাদের ক্রিকেট উন্নয়নে ভাল একটি ভুমিকা রাখতে পারব বলে আমি মনে করি।
তবুও আশাবাদী
না আমার সর্বশেষ কথার বিপরীত কোন কথা বলছিনা। আমি আশাবাদী বলছি শ্রীলংকার সাথে পারফরমেন্সে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখে। সেই খেলায় ব্যাটিং ইন্টেন্ট দেখা গেছে মোসাদ্দেক ও মিরাজের মধ্যে এবং আরো অনেকেই চেষ্টা করেছেন, যার ফলে একটা ভাল সংগ্রহ হয়েছিল, যদিও বোলারদের ব্যর্থতায় আমরা সে খেলায় হেরেছি। সাকিবের মধ্যে আমরা একজন ভাল অধিনায়ক পেয়েছি। শ্রীরাম একজন ভাল কোচ বলেই মনে হচ্ছে। লিটন, ইয়াসির রাব্বি ও হাসান মাহমুদ ফিরে এলে দলটি আরো শক্তিশালী হবে বলে মনে হয়। কিন্তু এও মানতে হবে যে এটা কেবল শুরু এবং আমাদের অনেক দুরের পথ পাড়ি দিতে হবে। ক্রিকেট খেলে এগারজন। আর আমার দৃষ্টিতে এগারটি সমস্যা আছে আমাদের ক্রিকেটে যা এখানে আলোচনা করলাম। আমার বিশ্বাস, যদি একে একে এই এগারটি বিষয়ে আমাদের ক্রিকেট সঠিক পথে এগোয়, তবে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা ইনশা আল্লাহ ভাল একটি টি২০ দল গঠন করতে পারব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে, তারা নিজেরা কতটুকু ভাবেন এই বিষয়গুলো নিয়ে। চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন করে নতুন পথে ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব যাদের তারা এ ব্যাপারে কতটুকু সিরিয়াস? আশা করি আমাদের দেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট যারা তারা আমার এই পয়েন্টগুলো একটু চিন্তা করে দেখবেন।
ডঃ সালমান আল-আযামী ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত একজন বৃটিশ বাংলাদেশী লেখক ও গবেষক। ( লেখাটি আমার দেশ পত্রিকা থেকে পাঠকের সুবিধার জন্য তুলে ধরা হলো।)
Discussion about this post