আক্তারুজ্জামান
বানের জলে ভাসছে মানুষ। অথৈ পানিতে ডুবে আছে চারদিক। নেই আশ্রয়, নেই খাবার। আশ্রয়কেন্দ্র নামক জটিল জায়গাতে পাওয়া একটু ঠাঁই আকড়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু নামে না বানের পানি, বরং বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে হাত ফসকে পানির অতল গহ্বরে পড়ে হারিয়ে গেছে একমাত্র সম্বল গবাদী পশুটাও। বিপর্যস্ত এই বানভাসী মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে হাজারো জনতা। যাদের বেশিরভাগই ধর্মীয় লেবাসপরা।
কিছুদিন আগেও দেশজুড়ে ধর্মীয় লেবাসধারীদের নিয়ে চরম উৎকণ্ঠা দেখিয়েছিল একটি পক্ষ। এমনকি তাদের বিচার, তাদের সম্পত্তির উৎস, আয়-ব্যয়ের হিসাব সব নিয়ে তাদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দেশের এই জাতীয় দুর্যোগে তাদেরকে দেখা যায়নি মানুষের পাশে। বরং এই দুঃসময়ে যার যতটুকু আছে, ততটুকু নিয়ে বন্যার্তদের পাশে ছুটে গিয়েছেন হুজুররা(!)। সেই সঙ্গে আছেন তরুণ প্রজন্মের কিছু উদ্যোমী মানুষকে। যারা সাধ্যমত চেষ্টা করছেন মানুষকে সহায়তা করতে।
তবে নবীপ্রেমী মানুষদের সহায়তার নমুনা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে, ইসলামের সেই সোনালী অতীতের কথা। যেখানে দলীয় কোনো ভেদাভেদ ছিল না। যারা নিজের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতো অন্য ভাইকে। নিজের ভালো জিনিসটা শেয়ার করে নিতো আরেক ভাইয়ের সাথে। তৃষ্ণার্ত সাহাবী পানি না খেয়ে আরেক ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিতো। মানুষের সাহায্যের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতো। সেই সময়ই যেনো দেখা দিলো বাংলাদেশে।
সম্প্রতি দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় সহযোগীতা করে ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো সেই সোনালী অতীতে নিয়ে গেলো আমাদের। সহায়তার সময় নিজ ধর্ম বা অন্য ধর্ম দেখেনি তারা। বিপদে পড়া সকল মানুষকে সমানভাবে সাহায্য করেছেন তারা। নিজেদের পকেটের টাকায় তহবিল গঠন করে কিনেছেন জরুরি পণ্য। জীবন বাজি রেখে বন্যার পানির মধ্যে নেমে দিচ্ছেন খাদ্য সহায়তা।
উপদ্রুত এলাকার জনসংখ্যার তুলনায় ত্রাণের সরবরাহও নিতান্ত স্বল্প। এ অবস্থায় দেশের বিত্তবান ব্যবসায়ী গ্রুপ, শিল্পপতি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সেবামূলক সংস্থার ভূমিকা চোখে পড়ছে না। ব্যক্তিগত ও স্থানীয় কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে। বিশেষভাবে নজরে পড়ছে দেশের ধর্মীয় সামাজিক সংগঠন, ইসলামী রাজনৈতিক দল, মাদ্রাসা, মসজিদ, আলেম-ওলামা, পীর মাশায়েখ, খানকা ও দরবারের অব্যাহত ত্রাণ তৎপরতা।
দেশের আলেম-ওলামা ও নবীপ্রেমিক জনতা আন্তরিকভাবে নিজেদের সীমিত শক্তি নিয়ে বন্যার্তদের মাঝে পড়ে রয়েছেন। নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চ নিয়ে তারা হাওরের বুকে বিচরণ করছেন। বিচ্ছিন্ন ক্ষুধার্ত ও ভেঙেপড়া মানুষকে সান্ত্বনা, মমতা ও খাদ্য ও পানি দিয়ে সঞ্জীবিত রাখছেন।
বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের যুবক তরুণ মানবতার সেবায় মাঠে রয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের বিপদে প্রবাসীরা নিজেদের লোকজনের সাহায্য করে যাচ্ছেন।
পানিবন্দি মানুষের মোবাইল ফোনচার্জ করার জন্য বিভিন্ন টিম ব্যবস্থা করছে। বিপজ্জনক স্থানে আটকেপড়া জনগোষ্ঠীকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য সিলেটের বহু মাদ্রাসা ও মসজিদ ৫০/১০০ টাকা অনুরোধ পাওয়ামাত্র রিচার্জ পাঠাচ্ছে। এখানে শতকোটি টাকার বাণিজ্য করা মোবাইল অপারেটর ও প্রশাসনের কর্তব্য ছিল এটি।
শুধু এবারই নয়, কিছুদিন আগে সীতাকুণ্ডের একটি কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানে ওই রাতেই রক্ত দিতে, ওষুধ নিয়ে, খাবার নিয়ে, গাড়ী নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন হাজারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লী। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মানবতার সেবায় নিহত-আহতদের উদ্ধার করে সেবা-শশ্রুষা দিয়ে অনন্য নজির দেখিয়েছেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা।
যেখানে কিছু মানুষ মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক পালন করছে, সেখানে দাড়ি-টুপি আর জোব্বা পরা মানুষগুলো সশরীরে উপস্থিত হয়ে সেবার নজির তৈরি করছে। নেই ফটোসেশনের তোড়জোর, নেই হুড়োহুড়ি। পরিচ্ছন্ন এক নিয়মের মধ্যে দিয়ে মানবিকতার নজির দেখানো এই মুসল্লী, আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে দেখে মুসলিমদের সোনালী ইতিহাস মনে পড়ায় স্বাভাবিক।!
Discussion about this post