অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গত ১০ ডিসেম্বর গুম-খুন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই সাত কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছে দেশের মানুষের কাছে একজন খুনি হিসেবে পরিচিত পুলিশের আইজি বেনজির আহমদের নামও।
কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার পর থেকে শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতা কর্মীরা বলছে-বিএনপি-জামায়াত যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার পেছনেও তাদের হাত রয়েছে। তবে মার্কিন বিচার দপ্তরের ওয়েবসাইট বলছে ভিন্ন কথা।
মার্কিন বিচার দপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞার আগে থেকেই সরকারের পক্ষে একাধিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
বিগত ১২ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য র্যাব-পুলিশ, বিজিবি ও ডিজিএফআই দিয়ে শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতা নেতাকর্মীকে গুম-খুন ও অপহরণ করিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকেন নি। এসব গুম-হত্যা চাপা দেয়ার জন্য হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। হাসিনার এসব লবিস্টরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে-মানবাধিকার সংস্থা দেশটির বিরোধী দলগুলোর করা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। হাসিনার লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে একটি গণমাধ্যম রিপোর্টও করেছে।
জানা গেছে, মার্কিন প্রশাসন, নীতিনির্ধারক, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একাধিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছে। এদের মধ্যে অন্তত আট বছর ধরে কাজ করছে ওয়াশিংটনভিত্তিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান বিজিআর। প্রতিষ্ঠানটি গত বছরেও র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা প্রচার করেছে। গত ডিসেম্বরে মার্কিন বিচার বিভাগে জমা হওয়া নথি পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
মার্কিন বিচার দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে শেখ হাসিনার একাধিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক চুক্তির আওতায় বিভিন্ন দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থরক্ষায় প্রচার ও সমর্থন আদায়ের কাজটি করে থাকে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর, কংগ্রেসম্যানসহ দেশটির রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারক মহলে প্রতিষ্ঠানগুলো যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।
মার্কিন আইন ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের (ফারা) আওতায় লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ছয় মাসে তাদের কার্যক্রমের বিবরণ যুক্তরাষ্ট্রের বিচার দপ্তরে জমা দিতে হয়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা কোনো চাঁদা দিয়ে থাকলে তার বিবরণ জমা দিতে হয়। এসব বিবরণ বিচার দপ্তর নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে থাকে।
শেখ হাসিনার নিয়োগকৃত লবিস্টরা বিজিআর গত বছর বাংলাদেশের জন্য মূলত মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছে এবং গণমাধ্যমের কাছে সরকারের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে। বিজিআরের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে দেখা যায়, গত বছর তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে ত্রৈমাসিক ৮০ হাজার ডলার করে পেয়েছে, বছরের যার পরিমাণ ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার (আনুমানিক ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা)।
এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে তিন লাখ ডলার ফি দেওয়ার শর্তে নিয়োগ করেছে বলে খবর বেরিয়েছিল (কালের কণ্ঠ, ২৮ জুলাই ২০১৯)। মূলত বিজিআর ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জন্য কাজ করে আসছে। (লবিংয়ে কেউ কম যান না, প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর ২০১৮)।
জানা গেছে, বিজিআর ছাড়াও গত বছর সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডল্যান্ডার গ্রুপের সঙ্গে এক মাসের জন্য একটি চুক্তি করেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম। এ চুক্তির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক আয়োজন ও সফর বিনিময়। এক মাসের জন্য ৪০ হাজার ডলার পেয়েছে ফ্রিডল্যান্ডার। এ ছাড়া কোনওয়াগো কনসালটিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ২৬ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট এই এক মাসের জন্য আরেকটি চুক্তি করে। ৩৫ হাজার ডলার অগ্রিম দেওয়ার শর্তে চুক্তিটি হয়, যাতে সই করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। কোনওয়াগোর সেবার মধ্যে সুনির্দিষ্ট করা ছিল মার্কিন সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা।
জানা গেছে, মার্কিন সিনেটরদের প্রস্তাব অনুযায়ী গত বছরের ২৬ জুন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডবিøউ) তাদের প্রতিবেদনে র্যাবের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেই প্রতিবেদনের একটি জবাব দেওয়া হয়েছে। ১৩ জুলাই বিজিআরের জনসংযোগবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অ্যালেক্স এলিস ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষে দূতাবাসের উপপ্রধান ফেরদৌসি শাহরিয়ারের স্বাক্ষরিত জবাব এইচআরডবিøউর প্রধান নির্বাহী কেনেথ রথ ও সংস্থাটির আরেকজন কর্মকর্তা জন সিফটনের কাছে ই–মেইল করেছেন।
‘বাংলাদেশ: হোল্ড সিকিউরিটি ফোর্সেস অ্যাকাউন্টেবল ফর টর্চার’ নামে এইচআরডবিøউর ওই প্রতিবেদনে র্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সিনেটররা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্টের আওতায় র্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, প্রতিবেদনে তা উল্লেখের পাশাপাশি জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট ও জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার নির্যাতনবিরোধী কমিটির পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করা হয়েছিল।
এদিকে গুম-খুনের সঠিক তথ্য চাপা দিতে দীর্ঘদিন ধরে লবিস্টদের পেছনে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে আসছিলেন শেখ হাসিনা। বিগত ১০ বছরে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা খরচ করেও গুম-খুন চাপা দিতে ব্যর্থ হলেন হাসিনা। গুম-খুনের দায়ে তার পালিত র্যাব এবং বেনজিরসহ শীর্ষ ৭ খুনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে।
Discussion about this post