ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোবাসা, যাতনা, ভাবনা- এসব নিয়ে দারুণ চিন্তিত ছিলেন। কিনারা করতে পারছিলেন না, কারে ভালোবাসা কয়, কারে যাতনা বলে, কাকে বলে ভাবনা। এ নিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। তাই রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধে গেছেন, ‘সখি ভাবনা কাহারে বলে, সখি যাতনা কাহারে বলে/তোমরা যে বলো, দিবস-রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা/সখি ভালোবাসা কারে কয়/ সে কি কেবলই যাতনাময়?’ এত সব যাতনা সত্ত্বেও ভালোবাসার হাসি হাসতে চেয়েছিলেন কবি। সেটি অবশ্য মন্দ নয়।
ইউটিউবে এক বন্ধু লিঙ্ক পাঠিয়েছেন। তাতে ‘সখি বাঙালি কারে কয়’ তার একটা পরিচয় ছিল। সেখানে বাঙালির ছয়-সাতটি সংজ্ঞা দেয়া আছে। যেমন যে বাসায় মাদুর আছে, তারা বাঙালি। যে বাড়িতে আমাশয় রোগ আছে তারা বাঙালি। যারা বেশি বেশি বিভিন্ন জাতের গুড় খায় তার বাঙালি। আর যাদের ঘরের খাটের নিচে আছে বিশ্বের বিস্ময়! পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য স্থান হচ্ছে মিসরের পিরামিড, চীনের প্রাচীর আর বাঙালি বাড়ির খাটের তলা। খাটের তলায় জিনিস ঠেসে দেয়া বাঙালির জন্মগত অধিকার। কী পাওয়া যাবে না সেখানে? বাবরের আমলের ট্রাঙ্ক, অশোকের আমলের সুটকেস, ধুলোমাখা পুজোর বাসন-কোসন, জুতোর বাক্স, হাড়গিলে ঝাঁটা, ছিপিহীন বোতল, ছেঁড়া পাপোশ। এ ছাড়া অজস্র কাপড়ের পুঁটুলি। তাতে কী আছে, কেউ জানে না। তবে বাঙালি বাড়ির ধুলোমাখা আলো-আঁধারি আমাদের বড় প্রিয়।
সেখানে বাঙালির আরো একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘যে জনগোষ্ঠী মান্ধাতার আমলের দ্রব্যসমূহ জমাইয়া রাখিতে বড়ই ভালোবাসে, সে জনগোষ্ঠীকেই বাঙালি কয়।’ একবার যদি বাঙালির বাড়িতে কোনো কিছু ঢোকে, সে আর ইহজীবনে বের হবে না। তাই বাঙালির বাড়ি খুঁজলে অজস্র পুরনো কীটে কাটা ম্যাগাজিন, পুরনো ছেঁড়া শাড়ি, শার্ট, জং ধরা টিনের কৌটো, লাখ লাখ রাবার ব্যান্ড, কোল্ড ড্রিংকসের হাজার হাজার বোতল, নানা সাইজের অজস্র দড়ি, কালি না পড়া কলম, বেঁকে যাওয়া পুরনো জুতো, দুধের অগণিত প্যাকেট, হাতল ভাঙা বালতি- এরকম অজস্র জিনিস খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা বলি, প্রত্যেকটি বাঙালি বাড়িই একেকটি মিনি জাদুঘর।
আরো অনেক সংজ্ঞা আছে ইউটিউবে। আর তা হলো, ‘লতার সহিত যে জনগোষ্ঠীর বিশেষ সাদৃশ্য খুঁজিয়া পাওয়া যায়, সেই জনগোষ্ঠীকেই বাঙালি কয়।’ উদ্ভিদ জগতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে মিল লতায়। লতা যেমন এলিয়ে পড়ে, বাঙালি তেমনি শিরদাঁড়া সোজা করে বেশিক্ষণ কোথাও বসতেই পারে না। খুব অল্পতেই এলিয়ে পড়ে। ইনফ্যাক্ট বাঙালি কোথায়ও বসে না, শুয়ে পড়ে। এটা কিন্তু একটা জাগতিক সত্য। রেল স্টেশনের প্লাটফরম হোক বা অফিসের চেয়ার হোক, কিংবা বাসের সিট হোক, কিংবা ট্যাক্সির সিট, এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ কিংবা সিনেমা হল, সব জায়গায় বাঙালি নেতিয়ে পড়ে। তাই পৃথিবীর কোনো কোনায় যদি দেখেন, কেউ বসতে গিয়ে এলিয়ে পড়ছে, তা হলে জানবেন, সে একজন খাঁটি বাঙালি।
প্রিয় পাঠক, আসলে বাঙালি কাহারে কয়, সে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য এই লেখা শুরু করিনি। আমি আসলে বলতে চাইছি, ‘দালাল কাহারে কয়’। বাঙালির চরিত্র সম্পর্কে এই মজার ব্যাখ্যাটি ইউটিউব থেকে তুলে ধরেছি, সাধারণভাবে বাঙালি চরিত্র বোঝাতে। ইউটিউবের এই ভাষ্যমতে, ‘বাঙালি কখনো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। এলিয়ে পড়ে।’ আমরাও এলিয়ে পড়ছি।
আসলে বাঙালি কারে কয়- আমার লেখার উপজীব্য বিষয় সেটি নয়। দেখানোর চেষ্টা করব, দালাল কাহারে কয়, সে বিষয়টি। ভারতে উৎপাদিত সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা ভারতের চাহিদা না মিটিয়ে রফতানি করা যাবে না- এমন ঘোষণায় বাংলাদেশে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তটিকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিএমএসএমইউ’র সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, ভারত সরকার যদি টিকা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে সেটি দুঃখজনক। আমরা আর কী করতে পারি? তাদের জিনিস তারা দেবেন না। পেঁয়াজের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর আমরা অন্য দেশ থেকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু ভ্যাকসিন তো আর নিয়ে আসতে পারব না। আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে, অন্য কোনো উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা যায় কি না, বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখন পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা: মুশতাক হোসেন বলেছেন, আমাদের যে নীতিমালা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অনুমোদন শুধু যুক্তরাজ্য দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেয়নি। কিংবা আরেকটি দেশ লাগবে। যেকোনো দু’টি দেশ বা অনুরূপ সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। না হলে আমাদের পুরো ডাটা অ্যানালাইসিস করার কাজটি সম্পন্ন করতে সময় লাগবে। ভারত সরকারের সাথে বেক্সিমকো যোগাযোগ করেছে। তারা বলেছেন, চুক্তি মোতাবেক ভ্যাকসিন পেতে সমস্যা হবে না। নিয়মনীতি মেনে আমরা এক সময় টিকা পাবো।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘ভারত যে টিকা দুই ডলারে পাচ্ছে, আমরা সেটি পাচ্ছি সোয়া পাঁচ ডলারে।’ অর্থের এই বাড়তি অংশ কে পাচ্ছে, তিনি সে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ভারতের সেরামকে প্রথম ধাপে যে ৬০০ কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ; তার চেয়ে কম টাকায় যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০ বিজ্ঞানীকে এক কোটি টাকা মাসিক বেতনে আনা হতো, তা হলে বাংলাদেশের ১২০ কোটি টাকা খরচ হতো। এখানে অনেক বেশি বিজ্ঞানী তৈরি হতে পারতেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দেশে এক বছরের মধ্যে টিকা তৈরি করা যেত। দেশের প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেককে যদি ৫০ কোটি টাকা সাবসিডি দেয়া হতো, তারাও দেশী বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ করতে পারতেন। এ ব্যবস্থা করা হলে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে টিকা আবিষ্কৃত হতো। ভারতীয় সেরাম ইনস্টিটিউটটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদার পুনেওয়ালা জানিয়েছেন, ‘তারা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে টিকা রফতানি করতে পারছেন না।’ সোজা ও সাফ কথা। কিন্তু পুনেওয়ালার এই বক্তব্যের প্রায় সাথে সাথে দালালরা এলোমেলো চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেন। ‘না, না, টিকা আসবে, টিকা পাওয়া যাবে, চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।’ এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেক্সিমকো দু’ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। কে যে কী বলছে, বাংলাদেশের জনগণকে ধুনপুন বোঝাচ্ছে- ধুলায় অন্ধকার। গত সোমবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো: আবদুল মান্নান বলেন, ‘টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে জিটুজি চুক্তি রয়েছে। এ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও উপস্থিত ছিলেন।’ এর পরপরই বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘আমরা সেরাম ইনস্টিটিউশনের সাথে যে চুক্তি করেছি, তা দু’দেশের সরকারের মধ্যে কোনো চুক্তি নয়। বেক্সিমকো যে চুক্তি করেছে, তা বাণিজ্যিক চুক্তি।’ সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনেও তিনি একই বক্তব্য দিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী সেরাম থেকে টিকা এনে বেক্সিমকো সরকারকে হস্তান্তর করবে।
অথচ সেরাম সিইও পুনেওয়ালা বলেছেন, ‘ভারত সরকারকে প্রাথমিকভাবে ১০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের পরই টিকা রফতানি করা সম্ভব হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে টিকা দিতে নিষেধাজ্ঞা আছে।’
তার পরও দালালেরা তৎপর। এলোমেলো কথা বলছেন তারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, করোনার টিকা রফতানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা দিলেও চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো বাংলাদেশ তা পাবে। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার খবর আসার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা হয়েছে। ভারতের হাই কমিশনারের সাথেও আলোচনা হয়েছে। তা ছাড়া তারা কথা বলেছেন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের এ দেশীয় অ্যাজেন্ট বেক্সিমকোর কর্মকর্তাদের সাথে। তারা কেউ নেতিবাচক কথা বলেননি।
ভারত যদি শেষ পর্যন্ত টিকা না দেয়, কী করবে সরকার? জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের শুধু প্রত্যাশা নয়, চুক্তি আছে তাদের সাথে। চুক্তিকে তারা নিশ্চয়ই সম্মান করবেন। টিকার দাম বাবদ অর্থ ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে। এটা প্রায় এক হাজার ২০ কোটি টাকা। টিকা নিয়ে বিকল্প ভাবনার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, চীন-রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সাথে আলোচনা হয়েছে টিকার পরীক্ষার বিষয়ে। চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করা হচ্ছে। তবে সংবাদ সম্মেলনের শেষের দিকে ঘটে মজার ঘটনা। মন্ত্রী সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে যখন বিদায় নিচ্ছেলেন, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব মুঠোফোনে কথা শেষ করে মন্ত্রীকে বলেন, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে একটি বার্তা এসেছে। মন্ত্রীর অনুমতি পেলে সেটি তিনি বলবেন। জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমি যেটা বলেছি ওটাই বলেন। সচিব বলেন, আমাদের যাবতীয় আলোচনাকালে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার উপস্থিত ছিলেন। ফলে ওই চুক্তি জিটুজি। কিন্তু বেক্সিমকো বলছে, না, চুক্তিটি জিটুজি নয়, বাণিজ্যিক। এদের নিয়ে কোথায় যাই! এ ব্যাপারে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’ বলে উদ্ভট মন্তব্যকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, দুশ্চিন্তা অমূলক। চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ।
অতএব, প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনারা বিবেচনা করুন, ‘দালাল কাহারে কয়’।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক