সোহরাব হাসান
করোনাসংকটের কারণে সাধারণ মানুষ সীমাহীন কষ্টে আছে। তাঁদের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই। তাই ত্রাণসামগ্রীর জন্য চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউন্সিলরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, রাস্তায় নামছেন, খোলাবাজারে চাল বিক্রির জন্য দাঁড়ানো ট্রাকের সামনে লাইন দিচ্ছেন করোনার ঝুঁকি নিয়েও। আবার অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে ঘরেই অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
আরেক শ্রেণির মানুষ সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চাল গরিব মানুষকে না দিয়ে বাড়িতে দোকানে, গুদামে এমনকি ঘরের মেঝের নিচে লুকিয়ে রাখতেও কসুর করছেন না। যেখানে ১০ টাকা দামের চাল বিক্রি হচ্ছে সেখানেই চুরি, যেখানে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি হচ্ছে সেখানেই আত্মসাৎ কিংবা মাপে কম দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার এ চালচোরদের হুঁশিয়ার করেছেন। একপর্যায়ে ওএমএসের চাল বিক্রি বন্ধও করে দেওয়া হয়েছিল। তাতেও চোরদের দৌরাত্ম্য কমেছে বলে মনে হয় না। প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে চাল উদ্ধার ও জব্দ করার খবর আসছে। অভিনব কায়দায় এঁরা চুরি করছেন। গরিবের চাল, তেল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের জন্য বুধবার পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন চেয়ারম্যান এবং ১২ জন সদস্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। অনেককে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেশ কজন জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করে মামলা দিয়েছে। তবে সব খবর পত্রিকায় আসে না।
অনেক সময় চুরি ও আত্মসাতের খবর প্রকাশ করতে গিয়ে সংবাদকর্মীরা হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হন। ভোলার আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের দ্বারা জেলেদের জন্য বরাদ্দ চাল আত্মসাতের খবর প্রকাশ করায় তাঁর পুত্র, যিনি ছাত্রলীগের নেতাও, এক সংবাদকর্মীকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হরহামেশা মামলা হচ্ছে।
এই চোরেরা জানেন বিচারে তাঁদের কিছু হবে না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারবেন। কোনো কোনো মন্ত্রী-নেতা তাঁদের পক্ষে সাফাই গাইতেও শুরু করেছেন। একজন মন্ত্রী বলেছেন, আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী নাকি চাল চুরি করতে পারেন না। এগুলো নাকি বিএনপি, জামায়াত ও জাসদের লোকেরা চুরি করছেন। মন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক হলে যেখানে চাল জব্দ হচ্ছে, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ধরা পড়ছেন কেন? প্রধানমন্ত্রী চোরদের ধরতে বলছেন। আর মন্ত্রীরা তাঁদের বাঁচাতে চেষ্টা করছেন। এতে চালচোরেরা আরও আশকারা পেয়ে যাবেন।
আরেকটি প্রবণতা ইদানীং দেখা যাচ্ছে, চাল চুরির সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনের কারও নাম আসার সঙ্গে সঙ্গে সংগঠন থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এটা আসলে দায় অস্বীকারেরই এক কৌশল।
এ পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত আরও ৫০ লাখ দরিদ্র ও দুস্থ মানুষকে রেশন কার্ড করে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে যে ৫০ লাখ চরম দরিদ্র মানুষ রেশন কার্ডের মাধ্যমে ১০ টাকা দরে চাল পাচ্ছেন, এ সংখ্যা তার অতিরিক্ত।
কীভাবে এবং কাদের চাল বিতরণ করতে হবে, তার একটি দিকনির্দেশনাও তিনি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যাঁরা হাত পাততে পারবেন না, তঁাদের জন্য এ কর্মসূচি।…কে কোন দল করল, কে কার পক্ষে, কে আমার পক্ষে না, কে আমার ভোটার, কে আমার ভোটার না, সেটি দেখার দরকার নেই। যার অবস্থা খারাপ, যিনি দুস্থ, যঁার ঘরে খাবার নেই, তাঁর ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে।’ তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তালিকা তৈরি করতে বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী যঁাদের কাছে তালিকা তৈরির ভার দিয়েছেন, তাঁরাই খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৫০ লাখ দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের তালিকা তৈরি করেছিলেন। তাঁরাই ভিজিএফ, ভিজিডির তালিকা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, এ কর্মসূচিতে দুই ধরনের অপচয় হয়। প্রথমত প্রকৃতই যাঁদের পাওয়ার কথা, তঁারা পান না। আর যে পরিমাণ চাল বরাদ্দ হয়, তা বিতরণ করা হয় না।
আগে কেন্দ্রে যে সরকারই থাকুক না কেন, স্থানীয় শাসন সংস্থাগুলোতে একটি ভারসাম্য থাকত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলো যেভাবে একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে, তাতে শতকরা ৯০ শতাংশ প্রতিনিধি ক্ষমতাসীন দলের। তঁারাই ডিলার, তাঁরাই বিতরণকারী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণকারীও। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যাঁদের জন্য এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, তাঁরা কতটা পাবেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো এসব তালিকা-কার্ড করতে যে সময় লাগবে, সেই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঘরে খাবার না থাকা মানুষগুলোর চলবে কীভাবে? তঁাদের কাছে এখনই খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো দরকার। রোগী মারা যাওয়ার পর বাড়িতে ডাক্তার গেলে কোনো লাভ হবে না।
এ অবস্থায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে যে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে, সেটি ভরসার জায়গা হতে পারত। কিন্তু সেখানেও অনিয়মের অন্ত নেই। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ এক–দশমাংশও নয়। বিভিন্ন স্থানে প্রকৃত গরিব ও অভাবী মানুষকে বাদ দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা মুখ দেখে, আইডি কার্ড দেখে ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন।
ঢাকার গরিব মানুষের ৯০ শতাংশ এখানকার ভোটার নন। বিশেষ করে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, হকার, মুটে, দিনমজুর, গৃহকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, পরিবহনশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিকেরা গ্রামের ভোটার। আইডি কার্ড বা ভোটার তালিকা দেখে ত্রাণসামগ্রী দেওয়ায় তাঁরা কিছুই পাননি। পেয়েছেন মেয়র-কাউন্সিলরদের ‘কাছের লোকেরা’। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে।
করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পেতে সরকার সবাইকে ঘরে থাকতে বলেছে। কিন্তু যে মানুষগুলোর ঘরে খাবার নেই, শিশুর দুধ নেই, করোনার ভয়কে উপেক্ষা করেই তাঁদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে। চুরি–চামারি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আসছে প্রায় সবখান থেকেই। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুরসহ বহু স্থানে মানুষ ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন।
সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, দেশে খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই। প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য গুদামে মজুত আছে। তাহলে ত্রাণের জন্য মানুষগুলো রাস্তায় কেন? সরকারের গুদামে চাল আছে। কিন্তু সেটি গরিব মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা নেই। মুখ চিনে ত্রাণসামগ্রী দেওয়ার চেয়েও বড় সমস্যা হলো ত্রাণসামগ্রী বা সহায়তা কর্মসূচির চাল মেরে দেওয়া। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসছে। আবার আওয়ামী লীগ থেকেই ত্রাণ কার্যক্রমে প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকার যদি সত্যই প্রকৃত গরিব, দুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী ও ১০ টাকার চাল পৌঁছাতে চায়, তাহলে কোনোভাবেই দলীয় লোকদের সম্পৃক্ত করা যাবে না। বরং যেসব বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি